আমার শবে বরাতময় একদিন

কথায় আছে, মায়ের চাইতেও মাসীর দরদ বেশি। তেমনি ভাবে, ধর্ম-কর্মের দ্বার না ধেরেও সেদিন বেশ পুলকিত ছিলাম। ঘটনাটি আমার কৈশর বেলার, তখন ক্লাশ সেভেন কি এইটে পড়ি। সেই সকাল থেকে ব্যস্ত। আম্মাকে একের পর এক উপদেশ আর নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছি, আজ স্পেশাল কি কি করতে হবে। পোলাও ও বিরিয়ানি মাস্টবি চাই-ই চাই। আর হালুয়া পাঁচ/ছয় আইটেমের কম হতে পারবে না। পাড়ার প্রতিবেশিদের পাশাপাশি আশপাশের সব বন্ধুর বাসায় এই বার ফাতেয়া (চট্টগ্রামে ভাল কিছু রান্না-বান্না হলে সওয়াবের নিয়তে হুজুর-মোল্লাসহ প্রতিবেশিদে দেয়াকে ফাতেয়া বলে) দেয়ার নিয়ত করেছি। আর রাতে সব বন্ধুকে দাওয়াত করেছি, তাদের জন্য লাল পরটা, মিষ্টি পরটা, চাউলের রুটি, গরু, মুরগী ইত্যাদি রান্না করতে হবে।

এত চাওয়া অনিচ্ছা সত্ত্বেও আম্মা করেছেন ঠিকই কিন্তু বোনাস হিসেবে কিছু গালমন্দ হজম করতে হচ্ছিল আমাকে। কারন কিছু পেতে হলেও কিছু দিতেতো হবেই।
তার ওপর আমার আবদারের কারনে অতিরিক্ত অকে কিছুই করতে হয়েছে। আম্মা এসব কিছু মেনে নেয়ার কারন হচ্ছে, এই বারের শবে বরাত থেকে আমি মোল্লা হওয়ার ওয়াদা করেছি তাঁর নিকট। প্রতিজ্ঞা করেছি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বো, কোরআন পড়তে ফোরকানিয়ায় যাব....

সকাল থেকেই বন্ধুদের সাথে একের পর এক পরিকল্পনা প্রণয়ন করছি। কিছুক্ষণ পর পর সেটি আবার সংযোজন, বিয়োজন করছি। দুপুরে খাওয়ার পর বন্ধুরা সব বাজারে গিয়ে কিনে আনলাম একগাধা ফোটকা, বাজি, মোমবাতি, আগরবাতি ইত্যাদি। ফাঁকে ফাঁকে শবে বরাতের মাসলা মাসায়েল জানার জন্য একটা মোকছিদুল মোমিনুনও কিনে আনলাম।

বিকাল বেলায় আসরের পর থেকে শুরু হয়েছে এর/ওর বাসায় ফাতেয়া চালাচালি। অবশ্য এই কাজে ছোট ভাই আমার ওপর বেশ ক্ষিপ্ত। কারন তাকে বেছে বেছে অপেক্ষাকৃত দূরের এবং জঞ্জাটিদের বাসায় পাটাচ্ছি। অন্যদিকে আমি কাছের এবাং সববয়সী মেয়েদের বাসায় সর্বাগ্রে দৌড় দিচ্ছি। এসব করতে করতে মাগরীবের আযান হয়ে গেছে।

আতশবাজিতে চিৎপটাং

সন্ধ্যায় নামাজ শেষে এক দৌড়ে বাসায় এসে গোসল করতে ঢুকে গেলাম। কারন মোকসেদুল মোমিনুন থেকে আসেই জেনে নিয়েছি এদিন বাদ মাগরীব গোসল করা সওয়াবের কাজ। গোসল শেষে নেমে গেলাম বন্ধুদের সাথে দুপুরের কেনা সেই আতস-বাজি ফুটাতে। (এখানে একটা বিষয় বলে রাখা প্রয়োজন বন্ধুর যে অর্থ এর প্রকৃতভাবে সেরকম কোন বন্ধু নয়। আমার এ জন্মে এখন পর্যন্ত একজনই বন্ধু, যারা সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে ইন্টারের পর)। বন্ধুরা সব একের পর এক বাজি ফোটাচ্ছে, কিন্তু আমার সাহসে দিচ্ছিল না, বাজি ফোটাতে। শেষাবদি সাহস করে হাতে নিলাম একটা ফোটকা। যখন একজনে সে ফোটকায় আগুন ধরিয়ে দিল তখন আমি পাশ ফিরে রিয়াজ নামে যে এখন বেঁচে নেই, কুকুরের কামরে তার মৃত্যু হয়েছে বছর খানেক পর) আরেক জনের সাথে কথা বলছিলাম। আগুন ধরে গেলে ওরা ছুড়ে মারতে বললে তরিগড়ি করে ছুড়ে মারলাম। কিন্তু ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে গেছে। হাত গুরিয়ে ছোড়ার আগেই ওটা ফুটে যায় আমার হাতেই। ফলাফল গলার অনেক জায়গায় দাগ হয়ে যায়।

কিছুক্ষণ পর ব্যাথা কমলে আবারও রওয়ানা দিলাম তাদের সাথে। কিন্তু না, এবার আর ফোটা না ফিটিয়ে একটা তারা বাত্তি আকাশে ছুরে মারলাম। বন্ধুরা সব বাজি আর তারা বাত্তি জ্বালানো ব্যস্ত, আমি একা অসহায় হাতের ম্যাচ বক্স খুলে একটা কাঠি নিয়ে হাতের ওপর রেখে আগুন ধরানো চেষ্টা করছিলাম। এমন সময় এক লোক এসে আমাকে ধরে নিয়ে গেল মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে। ইমাম সাহেব আব্বার নাম শুনে অবাক হয়ে বললেন, তুমিও এসব গুণার কাজ কর? জান না, এসব করলে মানুষের নামাজের ব্যঘাত ঘটে!

সিগারেটে হাতেখড়ি এবং বিড়ম্বনা:

এসব না করার শর্তে ইমাম সাহেবের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে বন্ধুদের সাথে যোগ দিলাম মসজিদে এশার পড়তে। নামাজে বন্ধুদের দুষ্টুমিটা হালকা বেড়েছে। নামাজ পড়া অবস্থায় একজন আমার পায়ে লাথি মারলে আমিও তার পায়ে লাথি মারলাম। হাসাহাসি খিল খিলের ভেতর আরেকজন হঠাৎ করে এক ধাক্কায় কাতারের অর্ধেক মানুষকে ফেলে দেয়। কয়েকজন মুরুব্বি তাদের পাশের গুলোকে ধরে থাপ্পড় চড় মেরে গাঢ় ধরে মসজিদ থেকে বের করে দিলে দোতালায় উঠে লুকোচুরি খেল্লাম কতক্ষণ। নামাজ শেষে বন্ধুদের বাসায় গিয়ে পেট পুরে খেলাম, এবং অন্যদের বাসায় গেলাম। যাওয়া আসার পথে এক মহা কাজ করে পেল্লাম। এক বন্ধুর কেনা গোল্ডলীফ সিগারেটে সুখ টানের মাধ্যমে ধুমপানে হাতিখড়ি হয়ে গেল (এর পর দ্বিতীয় সর্বশেষবার খেযেছিলাম বড় ভাইয়ের বিয়ের সময়, ক্লাশ নাইনে ওঠার পর। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত এটিকে বাজে অভ্যাস হিসেবেই ঘৃণা করে আসছি)। তবে মোটেও সুখকর ছিল না, এ অভিজ্ঞতা। প্রথম সিগারেট হাতে নেয়ার পর শরীরের কাপন যেন থামছিলই না। আগুন ধরিয়ে যখন টান পারতে গেলাম, তখন খেয়াল করলাম উল্টো যায়গায় আগুন ধরিয়েছি! যখন ঠিক করে আবার মুখে দিলাম, তখন আগেরবার লাগানো আগুনে ঠোট জ্বলে যায়। সিগারেট ফুঁকে মাত্র ধূঁয়া ছাড়বো এমন সময় দেখি আব্বা সামনে! দিলাম দৌড়; ভাগ্যভাল দেখে নাই। এভাবে প্রায় সাড়ে দশটা বাজলো। বাসায় গিয়ে মুখের ভেতর এবং সারা গায়ে পাফিউম মাখলাম। ঠোঁটের কথা বল্লাম বাজি ফোটাতে গিয়ে এ অবস্থা।

এক রাতের ভ্যান চালকঃ

এগারটার দিকে বের হলাম সফরে। কিছুদূর গিয়ে পাড়ার বস্তিতে গিয়ে তালা ভেঙ্গে একটা ভেন গাড়ি নিয়ে ওটাতে চেপে বসলাম সবাই। পালাবদলে একএকজন ঐ ভেনগাড়ির ড্রাইভার হয়ে গেলাম। একে একে মামা-বাগিনা, গরিবুল্লাহ, বদনাশা, পরিবিবি, বায়েজিদ বোস্তামীর মাজারে গিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে আসতে লাগলাম।

এক পর্যায়ে সিমেন্ট ক্রসিংয়ে গিয়ে ভেনটি চাকা পামছার যখন হল তখন রাত বাজে একটা। কি আর করার! ঠেলে ঠেলে ভেন গাড়ি নিয়ে দেওয়ানহাট মোড়ে আসতেই লেগে গেল আড়াইটা! ভেনে কিন্তু চুপ ছিলাম না। যিকির করছি, গজল গাচ্ছি। অন্যদিকে সিগারেট ফুঁকছি। শেষের দিকে একটা সেগারেট ৯ জনে মিলে সমভাগে ভাগ করে খাওয়া হল (একেই বলে বন্ধুত্ব)। এক পর্যায়ে টাকা শেষ হয়ে গেলে ২ টাকার ১৬টি আবুল বিড়ে কেনা হলেও ওটা খাওয়ার মত সুপুরুষ হতে পারিনি কেউই।

পীরের মুরিদঃ

দেওয়ানহাট মোড়ে এলে, বায়তুশ শরফ মাদ্রাসা পড়–য়া এক বন্ধু প্রস্তাব দিলে ভেনের কারনে আমরা ৩ জন ফিরে আসি। বাকি ৫ জন যায় বায়তুশ শরফ । সেখানে তারা পীরের মুরিদ হয়ে সারে ৩ টার দিকে মসজিদের ছাদে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তাদের ঘুম ভাঙ্গে সকাল ৯টায়।

অপর দিকে আমরা পাড়ায় ফিরে এসে যাদের ঘরে বাতি নিভানো দেখতাম, তাদের দরজার সামনে গিয়ে বোমা ফাটিয়ে আসতাম। এটাও ছওয়াবের উদ্দেশ্যে, কারন এই রাতেও তারা ঘুমায়!! এভাবে করতে করতে রাত ৩ বাজলে মসজিদে গিয়ে কতক্ষণ নামাজ পড়লাম। রাত ৪টার পর আর শরীরে এনার্জি না পেয়ে মসজিদের এক কোনায় ঘুমিয়ে পড়ি। ফজর নামাজের পর মোয়াজ্জিন মসজিদ বন্ধ করতে গিয়ে আমাদের থাপ্পড় দিয়ে ডেকে দিলে চোখ ঢলতে ঢলতে বাসায় গিয়ে ঘুুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে উলাম সকাল ১১ টায়। আম্মা ভীশন খুসি। ছেলে সারা রাত এবাদত করেছে। আসা করেন সারা জীবন এভাবেই এবাদত করবো!!! কিন্তু আমিতো জানি, কেমন এবাদত আমি করেছি

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাংলা চলচ্চিত্রের সংকট ও সীমাবদ্ধতাঃ দুইটি বাংলা চলচ্চিত্রের পর্যবেক্ষণ ও তুলনামূলক পর্যালোচনা

কথাগুলো 'সাম্প্রদায়িক'

Coverage of Local Development Issues in Regional Newspaper of Chattogram