আমার ভাইকে আমি আমার ডেরায় নিয়ে যাই!!! কবি ফর্রুখ, এখনো তিনি রয়ে গেছেন অবহেলিত
লিখেছেন আজব মানুষ ১৯ অক্টোবর ২০১২, সকাল ১১:০১
১৯ অক্টোবর! বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে শোকার্ত দিন। ১৯৭৪
সালে এই দিনে সমস্ত জাতিকে শোকের সাগরে ফেলে না ফেরার জগতে পারি জমিয়েছেন চির
অভিমানী কবি রেনেসাঁর কবি ফর্রুখ আহমদ। না কবির তো মৃত্যু হয়নি!
হয়েছিল একটি প্রতিভার, একটি জাতির জাগরনের চেতনার। তার
মৃত্যুতে ক্ষতি হল যেমন বাংলা সাহিত্যের তেমনি লজ্জিত হতে হল সমগ্র দেশকে। করাণ
তার মৃত্যু যে ছিল বঞ্চনার, অবজ্ঞার আর অবহেলার। মৃত্যুর সময় তার দেহটি ছিল কঙ্কালসাঁড়। তার বড় মেয়ে নাহার বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছিল কিন্তু পয়সার অভাবে ডাক্তার দেখাতে পারেন নি। ডাক্তার দেখাবেন কি ভাবে! তার পকেটে তো কোন কানা-কড়ি ছিল না। আর মেয়ের জামাই! তিনিও যে ছিলেন শ্বশুরের দোষে দোষি। কবির অপরাধ ? কবি সাম্প্রদায়িক! কবি তো মুসলমানদের জাগরণের কথা বলেন, তাদের ইতিহাস ঐতিহ্যকে স্বরণ করিয়ে তাদের ঘুম ভাঙ্গাবার চেষ্ট ছালিয়ে ছিলেন।
ডালে ডালে পাখির বাসা/মিষ্টি মধুর পাখির ভাষা/সাত সাগরে নদীর বাসা/কুলুকুলু নদীর ভাষা। হাজার সুরের হাজার ভাষায়/এ দুনিয়া ঘেরা/আর মাতৃভাষা বাংলা আমার/সকল ভাষার সেরা। যিনি নিজ মাতৃভাষাকে ভালবেসে লিখেছিলেন এরকম অসংখ্য কাব্য, ইসলামী আদর্শের কবিতা লিখার কারনে তিনি হয়েছিলেন সংকীর্ণ মৌলবাদি, সাম্প্রদায়িক। না এই অপরাধ তো ক্ষমার অযোগ্য, একে ক্ষমা করা যায় না। তাই তো
তারা বাংলাদেশ বেতারে কবির ৯৫০ টাকা বেতনের চাকরিটি কেড়ে নিল, তার সমস্ত রুজি রোযগারের পথ রূদ্ধ করে দেয় হল, তাকে করা হল বয়কট।
নির্জনে নিভৃতে ইস্কাটন কলোনীর কামরায় তিলে তিলে নিঃশেষিত হচ্ছিলেন। ছেলে মেয়েদের মুখে দু’মুঠো খাবার তুলে দেওয়াই ছিল ভার। এতসময় ভক্তদের চাপে ফিরিয়ে দেয়া হল তার কেড়ে নেয়া চাকরীটি, কিন্তু বেতন ৯৫০ থেকে কমিয়ে করা হল ৬৫০ টাকায়। এর মধ্যে তিনি বকেয়া বাসা ভাড়া পরিশোধ করে পেতেন মাত্র ৫০০ টাকা। এদিয়ে আর কি হয়! অগত্যা তার ছেলে মাহমুদ ডাক্তারী ছেড়ে ২২০ টাকা বেতনের চাকরি নিতে বাধ্য হলেন। তার উপর ছোট দুই মেয়ে লালা এবং ইয়াসমিনকে বিয়ে দিতে গিয়ে খেলেন হিমশিত।
এ অবস্থায় অর্ধাহারে, অনাহারে, দুশ্চিন্তায় আর এক রকম বিনা চিকিৎসায় সমাজের উপেক্ষার শিকার হয়ে বিদায় নিলেন চির অভিমানী র্ফরুখ ।
সমাজ আমাদের বড় নির্দয়, নিষ্ঠুর পাষাণ। তাই সমাজের ওপর ছিল কবির নিদারুন অভিমান। কিন্তু মুখ ফুটে সে কথা কোন দিন বলেন নি। নিজেকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দিয়ে চলে গেলেন।
ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্র মাজারের পাশে একটুখানি জমির জন্যে অনেকেই আকুতি জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কোন ফল হয় নি। সারা দেশের মানুষের যে কবি, তার জন্যে দেশের লোক আড়াই হাত ঘুমাবার ঠাঁই দিতে চাইলো না। এসব দেখে তাঁর ভাই কবি বেনজীর আহমদ বললেন, “আমার ভাইকে আমি আমার ডেরায় নিয়ে যাই।” বেনজিরের আমবাগানে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন জাগরনের কবি ফর্রুখ
আহমদ।
তাই আহমদ ছফার সাথে সুর মিলিয়ে বলতে হয়, ফর্রুখ মরেন নি, আমরা তাকে মেরেছি। তার মৃত্যুর পর ইবনে খলদুন বলেছিলেন “আমরা তিলে তিলে আরো একটি প্রতিভাকে খুন করলাম, বাংলা সাহিত্যের আরো অনেক দিকপালের মত ফর্রুখ আহমদকেও। আমরা তাঁর প্রতিভার মূল্য দিইনি। ডাকিনি সবার সামনে। বরং পেছনে বলে বেড়িয়েছি ফর্রুখ আহমদ মোল্লাদের কবি।”
রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরী?/এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে/সেতারা হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে/তুমি মাস্তুলে আমি দাঁড় টানি ভুলে/অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি’ জাতীয় জাগরণ ও চেতনার বুলবুলি কবি ফররুখ আহমদ ১৯১৮ সালের ১০ জুন তৎকালীন যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার মধুমতি নদী তীরের মাঝআইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। খানসাহেব সৈয়দ হাতেম আলী ও রওশন আখতারের দ্বিতীয় ছেলে ফররুখ আহমদ।
১৯৩৭ সালে খুলনা জিলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা, ১৯৩৯ সালে কলকাতা রিপন কলেজ থেকে আইএ পাস করার পর কলকাতা স্কটিশ চার্চ কলেজে ১৯৩৯ সালে দর্শন বিষয়ে, পরে ১৯৪১ সালে কলকাতা সিটি কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স নিয়ে বিএ-তে ভর্তি হন কবি ফর্রুখ আহমদ। ১৯৪৩ সালে আইজি প্রিজন অফিস ও ১৯৪৪ সালে সিভিল সাপ্লাই অফিসে কিছুদিন চাকরি করেন। এরপর সাংবাদিকতা ও সাহিত্যচর্চা নিয়েই জীবনের বৃহত্তর সময় কাটিয়েছেন তিনি। তিনি রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা ও বাংলাদেশ বেতারের নিজস্ব শিল্পী ছিলেন। বেতারে কিশোর মজলিস নামে একটি অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন দীর্ঘ দিন।
ফররুখ আহমদের কাব্যে ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, স্বদেশ, সমকাল ফুটে উঠেছে সার্থকভাবে। অফুরণ সৌন্দর্য, উদাস কল্পনা, রূঢ় বাস্তবতা, প্রদীপিত আদর্শ, সমুদ্রবিহার, রোমান্টিকতা, প্রেম প্রভৃতি তার কবিতার এক মৌলিক চরিত্র নির্মাণ করেছে। গানের ভুবনেও তার পদচারণা ছিল। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে গীতিকার হিসেবে তার ছিল ব্যাপক খ্যাতি। শিশুসাহিত্য, প্রবন্ধ, নাটক, অনুবাদসাহিত্যেও তার অবদান উল্লেখযোগ্য।
তার প্রথম ও সেরা কাব্যগ্রন্থ সাত সাগরের মাঝি ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া সিরাজাম মুনিরা, নৌফেল ও হাতেম, মুহূর্তের কবিতা, হাতেম তায়ী, পাখির বাসা, হরফের ছড়া, নতুন লেখা, ছড়ার আসর, হে বন্য স্বপ্নেরা, কাফেলা প্রভৃতি তার সাড়া জাগানো সাহিত্যকীর্তি।
সব্যসাচী লেখক মরহুম আবদুল মান্নান সৈয়দের মতে, ‘ফররুখ আহমদ ছিলেন অফুরানভাবে সৃষ্টিশীল। তার সৃষ্টি ধারায় কখনো ছেদ বা বিরতি পড়েনি। সব মিলিয়ে তার সাহিত্য-শস্যের পরিমাণ বিরাট’।
কবি ফররুখ আহমদের ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কিন্তু যেভাবে হওয়ার প্রয়োজন ছিল তার কিংদাংশও করা হয়নি। বরং এখনো তিনি রয়ে গেছেন সেই অবহেলিত।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন