আসুন পড়ি
আর কিছুক্ষণ বাকি, তারপরই ফ্রান্সিস উপকূল পৌঁছে যাবে। জাহাজটি যতই বন্দরের কাছাকাছি হচ্ছে ততই তার বুকের দুপদুপানিটা বেড়ে যাচ্ছে। এর আগেও সে কয়েকটি বন্দরে গিয়েছে কিন্তু জাহাজ থেকে নামার সাহস পায়নি।
যখন কোন বন্দরে গিয়ে জাহাজ দাঁড়াতো তখন সবাই নেমে গেলেও ফ্রান্সিস অন্ধকার কোন এক কোণে গিয়ে ঘাপটি মেরে থাকতো। পরে জাহাজ সেই বন্দর ছেড়ে আসলে তবেই তার প্রাণ ফিরে পেত।
কিন্তু এবার আর সেই উপায় নেই। নামতেই হবে তাকে। তাই সে নিজের জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে নিয়ে পাটাতনে গিয়ে দাঁড়ায়।
যাত্রী-মাল্লাদের সবার পেছনে দাঁড়িয়েছে সে। আসপাশটা ভাল করে দেখ নিল, যাতে করে মোহামেডানগুলো হামলা করতে আসলে অন্তত লুকানোর চেষ্টা করতে পারে। অবশ্য কাজ তাতে হবে বলে মনে হয় না।
ঐ তো পাড়ে লাল উর্দি পড়া কয়েকজন যবনকে দেখা যাচ্ছে। মুখে টিপিক্যাল মুসলিম দাড়ি, আর কোমরে তলোয়ার ঝুলানো।
এবার তার বিশ্বাস পুরোদস্তুর সত্যি হল। আসলেই মুসলিমরা খুনি-দস্যির দল। এদের হাতে পড়লে কপালে কী আছে সেটা ইশ্বরই জানেন।
এসব ভাবতে ভাবতেই সে চলে এলো পাটাতনের একেবারেই সম্মুখভাগে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই নামতে হবে তাকে।
কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন অঘটন চোখে পড়েনি। কাউকে হত্যা করেনি এই হিদেনের দল। তাই বুকে কিছুটা বল নিয়ে তার পা স্পর্শ করলো বন্দরের মাটি। জীবনে প্রথম কোন মুসলিম এলাকায় পা রাখলো সে।
কিন্তু একি! নামার সাথে সাথেই কয়েকজন মুসলিম সৈন্য তাকে ঘিরে ধরলো। একজন ছোঁ মেরে তার একমাত্র সম্বল কাঁধে ঝুলানো পুটলিটা নিয়ে গেল।
-কে তুই, কোথায় থেকে এলি, যাবি কই? একের পর এক প্রশ্নবাণে বেহাল।
জানালো নাম ফ্রান্সিস। এসেছে সুদূর ইউরোপের একটি শহর থেকে। শুনেছে এখানে নাকি অসুখ সাড়ানোর যাদু শেখানে হয়, তাই সেটা শিখতে এসেছে সে।
-যাদু! প্রথমে না বুঝলেও পড়ে বুঝলেন মুসলিম সেনাটি। তাই হেসে বললেন, আরে বোকা ঐটা যাদু না, ঐ টা বিজ্ঞান। চিকিৎসা বিজ্ঞান। এখানে মেডিকেল কলেজে সেটা শেখান আমাদের ডাক্তার পণ্ডিতেরা।
-মেডিকেল, ডাক্তার, চিকিৎসা এগুলো কী?
-কেন তোমাদের দেশে কি এগুলো নেই?
-না।
তাহলে তোমাদের দেশে মানুষের অসুখ হলে কী করা হয়?
- কিছুই করার থাকে না, অসুখ হলে চটপট করে একদিন মারা যায়। আর হাতে বা পায়ে কোন পোড়া হলে সে হাত বা পা কেটে ফেলা হয়। অথবা যদি কারো চোখের সমস্যা হয়, তাহলে বৈদ্যরা সে চোখ উপড়ে ফেলেন, যেভাবে দাঁতে ব্যাথা হলে চিমটি দিয়ে টেনে সেই দাঁতটা উঠিয়ে ফেলা হয়।
ফ্রান্সিসের কথা শুনে বাজ পড়লো যেন মুসলিম সৈন্যদের মাথায়। এটা কীভাবে সম্ভব! ইউরোপে কোন চিকিৎসা ব্যাবস্থা নেই! অথচ তাদের দেশে আছে অত্যাধুনিক হাসপাতাল।
কথার ফাঁকে কিন্তু মুসলিম সৈন্যরা বসে নেই৷ তারা ফ্রান্সিসের পুটলিটি তন্নতন্ন করে কিছু একটা খুঁজছিল।
এক পর্যায়ে তল্লাসিরত এক সেনা পেয়েছি, পেয়েছি বলে ছেঁচিয়ে উঠলো। ফ্রান্সিসের প্রাণতো যায় যায় অবস্থা। কিছু থাকার কথা না, কিন্তু কী পেয়েছে ইশ্বরই জানে। আজ তার প্রাণ গেল বলে!
ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো সে। এ সময়ে এতক্ষণ কথা বলা লোকটাই বললো এই কিতাব কি তোমার?
কিতাব! ও হ্যা, বই? কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে জবাব দিল জ্বী। এইটা আসার সময় আমাকে এক বয়ষ্ক জ্ঞানী লোক জাহাজে দিয়েছেন। সেবার করার ইনাম হিসেবে । বলেছেন, এইটা সঙ্গে রাখ। অনেক উপকারে আসবে।
-ঠিক আছে, এইটা আমাদের লাগবে।
- কিন্তু...
- কোন কিন্তু নয়। আজ এইটা আমারা নিয়ে যাচ্ছি। দুই দিন পর ঠিক এই সময়ে ঐ যে লম্বা দালানটা দেখছো, ওখানে এসে এইটা নিয়ে যাবে। সাথে তোমার জন্য পুরষ্কারও আছে।
মনে মনে ইশ্বরের শুকরিয়া করলো ফ্রান্সিস। যাক বাবা বাঁচা গেল। কী ভয়ঙ্করই না এই মোহামেডানগুলো! সামান্য একটা বইয়ের লোভ সামলাতে পারলো না এরা। যত্তসব নীচু আর ডাকাতের দল!
তিনদিন পর ভয়ে ভয়ে এল সে। পুরষ্কারের জন্য নয়, আসলে সে ঐ বড় দালানে কী আছে আর তার বইটা নিয়ে এরা কী করলো সেটা জানার জন্যই ফ্রান্সিস এসেছে এখানে।
ইতস্তত করতে করতে ঢুকেই গেল৷ কিন্তু হায় ইশ্বর, একি! এ তো দেখছি বই আর বই। এত হাজার হাজার বই এরা পেল কোথায়?
তন্ময় হয়ে দেখছে সে। আচমকা কাঁদে হাতের ছোঁয়ায় সম্বিত ফিরলো তার। সে দিনের নেতা গোছের সেই সেনাটা।
আজ একটু বন্ধুপ্রবণ মনে হল। তাই ফ্রান্সিস তাকে বললো এত সুন্দর বাড়িতে এসব বইপত্র কেন?
লোকটা মৃদু হেসে বললেন, কারণ এই বাড়িটা নির্মিত হয়েছে এসেব বইপত্রের জন্যই। এটা হচ্ছে বাগদাদের সেই বিখ্যাত গ্রন্থাগার। খলিফাতুল মুসলিমিনের নিবিড় তত্ত্বাবধানে বছরের পর বছর ধরে গড়ে উঠেছে এই গ্রন্থাগারটি। পৃথিবীর জ্ঞানের স্বর্গরাজ্য এটি।
এই বলে লোকটা তার বই ফেরত দিল। বললো তোমাকে ধন্যবাদ এই বইটির জন্য। অতি প্রাচীন এই বইটি আমাদের এই গ্রন্থাগারে ছিল না। তোমার কাছে পাওয়া বইটি পেয়েই আমাদের অনুবাদকেরা এটির অনুবাদ করে নিয়েছে। এখন তোমারটি তুমি নিয়ে যেত পার। আর চাইলে এই গ্রন্থাগারের পাশের বিশ্ববিদ্যালয়ে তুমি ভর্তি হয়ে যেত পার। খলিফা তোমার জ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ দেখে ভর্তির অনুমতি দিয়েছে।
নাম ও কাহিনী কল্পিত হলেও ঘটনা কিন্তু বাস্তব। মধ্যযুগ থেকে শুরু করে বর্তমান আধুনিক সভ্যতার নির্মাণ যাদের হাত ধরে সেই মুসলিমরা এভাবেই সমৃদ্ধ করতো তাদের দেশের লাইব্রেরী গুলো। [সূত্রঃ guide to the use of books and Libraries, megrow hill]
ইসলাম ধর্মের শুরু থেকেই তারা জ্ঞানচর্চার প্রতি সবচেয়ে বেশি নজর দিয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে মুসলিম সাম্রাজ্যগুলো সেই ধারা অভ্যাহত রাখে।
এই জন্য মুসলিম দেশগুলোর বন্দরে, সরাইখানা ও লোকালয়ে জ্ঞানপিপাসুরা অপেক্ষায় থাকতো নতুন কোন বইয়ের সন্ধানে। যখনই কোন নতুন বই কারো কাছে পেত তখনই সেটা নিয়ে নিত এবং অনুবাদ বা কপি করে সেটা তারা ফেরত দিত।
আর এভাবেই জ্ঞান-বিজ্ঞানে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে তারা অর্ধ পৃথিবীকে নেতৃত্ব দিয়েছিল হাজার বছর ধরে। যখনই তারা সেটা থেকে আস্তে আস্তে দূরে সড়ে গেছে তখনই নেতৃত্ব তাদের হাত ছাড়া হয়ে গেছে।
এজন্যই চেঙ্গিস-হালাকু সহ যারাই মুসলিম রাজ্যগুলোতে হামলা করতো, প্রথম সুযোগেই তারা জ্ঞান চর্চাকেন্দ্রগুলোকে ধ্বংস করব দিত।
মুসলিমদের এই জ্ঞানচর্চার ইতিহাস কিন্তু এমনিতেই শুরু হয়নি। বরং ইসলামের আবির্ভাবকাল থেকেই শুরু হয়েছে তাদের এই জ্ঞানচর্চার কার্যক্রম।
ইসলাম আবির্ভাবকালে পৃথিবী যখন ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন পল্লীতে, তখন হযরত মুহাম্মাদের (সঃ) ওপর প্রভুর প্রথম বাণী এল 'পড়'।
ব্যাস, সেই থেকে শুরু। ইসলাম মানবজাতিকে মুক্তির পথ বলে দিল। একটাই পথ, মুক্তি পেতে চাও? তবে পড়, পড় এবং পড়।
আল্লাহর কাছ থেকে অদৃষ্ট হবার পর রাসূল (সঃ) শুরু করলেন অন্ধকার পৃথিবীকে আলোকিত করবার। এজন্য প্রথমেই তিনি নজর দিলেন একদল শিক্ষিত শিষ্য তৈরির দিকে।
তাই তিনি ঘোষণা দিলেন, যে জাতির কলম যত শক্তিশালী সে জাতি তত প্রতিষ্ঠিত ও উন্নত হতে পারে।
ঘোষণা দিয়েই তিনি বসে থাকেননি। মক্কার কাফেরেরা মুসলিমদের মদীনা আক্রমণ করলে বদর যুদ্ধে তার নেতৃত্বে কাফেরদের পরাজিত করা হয়। এ সময়ে বন্দী হওয়া অনেক কাফেরকে আল্লাহর রাসুল মুক্তি দিয়েছেন এমন এক শর্তে যা বিশ্বের ইতিহাসে কেবল প্রথমই নয়, বরং এটা বিরল এক ঘটনা। সেটি হচ্ছে, নবীর যেসব সাথী লেখতে ও পড়তে জানেন না, তাদের ১০ জনকে লেখাপড়া শেখাতে পারলে একজন বন্দী মুক্তি পাবেন। এটা ছিল যারা শিক্ষিত তাদের জন্য মুক্তির একমাত্র শর্ত।
এভাবেই রাসুল (সঃ) প্রতিষ্ঠা করলেন আসহাবে সুফফা নামে এমন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেখানকার শিক্ষার্থীরা খেয়ে না খেয়ে কেবলমাত্র জ্ঞানচর্চার জন্যই মসজিদে নববীতে পড়ে থাকতেন।
এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আবু হোরায়রা (রাঃ)। যিনি নবীর মুখের কোন হাদীস শুনলে সাথে সাথে তা মুখস্ত করে নিতেন। যার কল্যাণে দেড় হাজার বছর পরও মুসলিমরা আজও ধর্মচর্চা করে আসছে।
এখানকার আরেক শিক্ষার্থীর নাম হযরত আনাস (রাঃ), যিনি রাসূলের আদেশ, নিষেধ ও উপদেশগুলো লিখে রাখতেন৷ আবার লেখার মধ্য কারেকশন আছে কিনা দেখবার জন্য তা রাসুলকে (সঃ) পড়ে শোনাতেন।
বিশ্বনবী যখন সাহাবীদেরকে শিক্ষিত করে সেখান থেকে ২৬ জনকে মক্কায়, ৫১ জনকে কুফায়, ১৬ জনকে মিসরে, ৬ জনকে খোরাসানে এবং ৩ জনকে জাযীরায় পাঠিয়ে দিলেন সেখানকার অধিবাসীদের শিক্ষিত করবার জন্য [সূত্রঃ হাদীসের তত্ত্ব ও ইতিহাস]
এরপর রাসুলের মৃত্যুর পর তার প্রিয় সাহাবীদের হাত ধরে এই কার্যক্রমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যায়। আলী (রাঃ) কুফায় প্রতিষ্ঠা করেন লাইব্রেরী ও জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস যখন মারা যান, তখন তার কাছে ছিল এক বোঝা বই। যা একটি বড় উটে বইয়ে নিয়ে যেত কষ্ট হত।
সে সময়ের মুসলিম শাসকদের রাষ্ট্রীয় খরচের অন্যতম খাত ছিল জ্ঞানচর্চা ও লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা। লাইব্রেরীয়ানদের যে বেতন ছিল তা সে সময়ের বড় বড় সরকারি আমলারাও পেত না।
সে সময়ের গড়া আল হাজার লাইব্রেরীটা আজকের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়।
তখনকার মুসলিম শাসকেরা জ্ঞানচর্চা নিয়ে প্রতিযোগীতা করতো। কে, কার চেয়ে বড় লাইব্রেরী বানাবেন তার প্রতিযোগিতা।
তাদের গড়া লাইব্রেরীগুলোতে হাজার হাজার বই থাকতো। আর এসব লাইব্রেরীর ছাত্ররাই হয়েছিলেন একেকজন জাবের ইবনে হাইয়ান, আলবিরুনী, আল খারেজমি, বাইহাকী, মুজাম আল উবাদা, ওমর খৈয়াম, ইবনে বতুতা, ইবনে সিনার মত জগৎ বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা।
তারা একই সাথে যেমন ছিলেন বিজ্ঞানী, তেমনি দার্শনিক, ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ তেমনিভাবে রণাঙ্গনের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা। আর সবই সম্ভব হয়েছে জ্ঞান চর্চার কারণে।
কিন্তু আজ কোথায় সেই জ্ঞানচর্চা, কোথায় সেই বই পাগল মুসলিম জাতি?
যখন কোন বন্দরে গিয়ে জাহাজ দাঁড়াতো তখন সবাই নেমে গেলেও ফ্রান্সিস অন্ধকার কোন এক কোণে গিয়ে ঘাপটি মেরে থাকতো। পরে জাহাজ সেই বন্দর ছেড়ে আসলে তবেই তার প্রাণ ফিরে পেত।
কিন্তু এবার আর সেই উপায় নেই। নামতেই হবে তাকে। তাই সে নিজের জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে নিয়ে পাটাতনে গিয়ে দাঁড়ায়।
যাত্রী-মাল্লাদের সবার পেছনে দাঁড়িয়েছে সে। আসপাশটা ভাল করে দেখ নিল, যাতে করে মোহামেডানগুলো হামলা করতে আসলে অন্তত লুকানোর চেষ্টা করতে পারে। অবশ্য কাজ তাতে হবে বলে মনে হয় না।
ঐ তো পাড়ে লাল উর্দি পড়া কয়েকজন যবনকে দেখা যাচ্ছে। মুখে টিপিক্যাল মুসলিম দাড়ি, আর কোমরে তলোয়ার ঝুলানো।
এবার তার বিশ্বাস পুরোদস্তুর সত্যি হল। আসলেই মুসলিমরা খুনি-দস্যির দল। এদের হাতে পড়লে কপালে কী আছে সেটা ইশ্বরই জানেন।
এসব ভাবতে ভাবতেই সে চলে এলো পাটাতনের একেবারেই সম্মুখভাগে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই নামতে হবে তাকে।
কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন অঘটন চোখে পড়েনি। কাউকে হত্যা করেনি এই হিদেনের দল। তাই বুকে কিছুটা বল নিয়ে তার পা স্পর্শ করলো বন্দরের মাটি। জীবনে প্রথম কোন মুসলিম এলাকায় পা রাখলো সে।
কিন্তু একি! নামার সাথে সাথেই কয়েকজন মুসলিম সৈন্য তাকে ঘিরে ধরলো। একজন ছোঁ মেরে তার একমাত্র সম্বল কাঁধে ঝুলানো পুটলিটা নিয়ে গেল।
-কে তুই, কোথায় থেকে এলি, যাবি কই? একের পর এক প্রশ্নবাণে বেহাল।
জানালো নাম ফ্রান্সিস। এসেছে সুদূর ইউরোপের একটি শহর থেকে। শুনেছে এখানে নাকি অসুখ সাড়ানোর যাদু শেখানে হয়, তাই সেটা শিখতে এসেছে সে।
-যাদু! প্রথমে না বুঝলেও পড়ে বুঝলেন মুসলিম সেনাটি। তাই হেসে বললেন, আরে বোকা ঐটা যাদু না, ঐ টা বিজ্ঞান। চিকিৎসা বিজ্ঞান। এখানে মেডিকেল কলেজে সেটা শেখান আমাদের ডাক্তার পণ্ডিতেরা।
-মেডিকেল, ডাক্তার, চিকিৎসা এগুলো কী?
-কেন তোমাদের দেশে কি এগুলো নেই?
-না।
তাহলে তোমাদের দেশে মানুষের অসুখ হলে কী করা হয়?
- কিছুই করার থাকে না, অসুখ হলে চটপট করে একদিন মারা যায়। আর হাতে বা পায়ে কোন পোড়া হলে সে হাত বা পা কেটে ফেলা হয়। অথবা যদি কারো চোখের সমস্যা হয়, তাহলে বৈদ্যরা সে চোখ উপড়ে ফেলেন, যেভাবে দাঁতে ব্যাথা হলে চিমটি দিয়ে টেনে সেই দাঁতটা উঠিয়ে ফেলা হয়।
ফ্রান্সিসের কথা শুনে বাজ পড়লো যেন মুসলিম সৈন্যদের মাথায়। এটা কীভাবে সম্ভব! ইউরোপে কোন চিকিৎসা ব্যাবস্থা নেই! অথচ তাদের দেশে আছে অত্যাধুনিক হাসপাতাল।
কথার ফাঁকে কিন্তু মুসলিম সৈন্যরা বসে নেই৷ তারা ফ্রান্সিসের পুটলিটি তন্নতন্ন করে কিছু একটা খুঁজছিল।
এক পর্যায়ে তল্লাসিরত এক সেনা পেয়েছি, পেয়েছি বলে ছেঁচিয়ে উঠলো। ফ্রান্সিসের প্রাণতো যায় যায় অবস্থা। কিছু থাকার কথা না, কিন্তু কী পেয়েছে ইশ্বরই জানে। আজ তার প্রাণ গেল বলে!
ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো সে। এ সময়ে এতক্ষণ কথা বলা লোকটাই বললো এই কিতাব কি তোমার?
কিতাব! ও হ্যা, বই? কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে জবাব দিল জ্বী। এইটা আসার সময় আমাকে এক বয়ষ্ক জ্ঞানী লোক জাহাজে দিয়েছেন। সেবার করার ইনাম হিসেবে । বলেছেন, এইটা সঙ্গে রাখ। অনেক উপকারে আসবে।
-ঠিক আছে, এইটা আমাদের লাগবে।
- কিন্তু...
- কোন কিন্তু নয়। আজ এইটা আমারা নিয়ে যাচ্ছি। দুই দিন পর ঠিক এই সময়ে ঐ যে লম্বা দালানটা দেখছো, ওখানে এসে এইটা নিয়ে যাবে। সাথে তোমার জন্য পুরষ্কারও আছে।
মনে মনে ইশ্বরের শুকরিয়া করলো ফ্রান্সিস। যাক বাবা বাঁচা গেল। কী ভয়ঙ্করই না এই মোহামেডানগুলো! সামান্য একটা বইয়ের লোভ সামলাতে পারলো না এরা। যত্তসব নীচু আর ডাকাতের দল!
তিনদিন পর ভয়ে ভয়ে এল সে। পুরষ্কারের জন্য নয়, আসলে সে ঐ বড় দালানে কী আছে আর তার বইটা নিয়ে এরা কী করলো সেটা জানার জন্যই ফ্রান্সিস এসেছে এখানে।
ইতস্তত করতে করতে ঢুকেই গেল৷ কিন্তু হায় ইশ্বর, একি! এ তো দেখছি বই আর বই। এত হাজার হাজার বই এরা পেল কোথায়?
তন্ময় হয়ে দেখছে সে। আচমকা কাঁদে হাতের ছোঁয়ায় সম্বিত ফিরলো তার। সে দিনের নেতা গোছের সেই সেনাটা।
আজ একটু বন্ধুপ্রবণ মনে হল। তাই ফ্রান্সিস তাকে বললো এত সুন্দর বাড়িতে এসব বইপত্র কেন?
লোকটা মৃদু হেসে বললেন, কারণ এই বাড়িটা নির্মিত হয়েছে এসেব বইপত্রের জন্যই। এটা হচ্ছে বাগদাদের সেই বিখ্যাত গ্রন্থাগার। খলিফাতুল মুসলিমিনের নিবিড় তত্ত্বাবধানে বছরের পর বছর ধরে গড়ে উঠেছে এই গ্রন্থাগারটি। পৃথিবীর জ্ঞানের স্বর্গরাজ্য এটি।
এই বলে লোকটা তার বই ফেরত দিল। বললো তোমাকে ধন্যবাদ এই বইটির জন্য। অতি প্রাচীন এই বইটি আমাদের এই গ্রন্থাগারে ছিল না। তোমার কাছে পাওয়া বইটি পেয়েই আমাদের অনুবাদকেরা এটির অনুবাদ করে নিয়েছে। এখন তোমারটি তুমি নিয়ে যেত পার। আর চাইলে এই গ্রন্থাগারের পাশের বিশ্ববিদ্যালয়ে তুমি ভর্তি হয়ে যেত পার। খলিফা তোমার জ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ দেখে ভর্তির অনুমতি দিয়েছে।
নাম ও কাহিনী কল্পিত হলেও ঘটনা কিন্তু বাস্তব। মধ্যযুগ থেকে শুরু করে বর্তমান আধুনিক সভ্যতার নির্মাণ যাদের হাত ধরে সেই মুসলিমরা এভাবেই সমৃদ্ধ করতো তাদের দেশের লাইব্রেরী গুলো। [সূত্রঃ guide to the use of books and Libraries, megrow hill]
ইসলাম ধর্মের শুরু থেকেই তারা জ্ঞানচর্চার প্রতি সবচেয়ে বেশি নজর দিয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে মুসলিম সাম্রাজ্যগুলো সেই ধারা অভ্যাহত রাখে।
এই জন্য মুসলিম দেশগুলোর বন্দরে, সরাইখানা ও লোকালয়ে জ্ঞানপিপাসুরা অপেক্ষায় থাকতো নতুন কোন বইয়ের সন্ধানে। যখনই কোন নতুন বই কারো কাছে পেত তখনই সেটা নিয়ে নিত এবং অনুবাদ বা কপি করে সেটা তারা ফেরত দিত।
আর এভাবেই জ্ঞান-বিজ্ঞানে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে তারা অর্ধ পৃথিবীকে নেতৃত্ব দিয়েছিল হাজার বছর ধরে। যখনই তারা সেটা থেকে আস্তে আস্তে দূরে সড়ে গেছে তখনই নেতৃত্ব তাদের হাত ছাড়া হয়ে গেছে।
এজন্যই চেঙ্গিস-হালাকু সহ যারাই মুসলিম রাজ্যগুলোতে হামলা করতো, প্রথম সুযোগেই তারা জ্ঞান চর্চাকেন্দ্রগুলোকে ধ্বংস করব দিত।
মুসলিমদের এই জ্ঞানচর্চার ইতিহাস কিন্তু এমনিতেই শুরু হয়নি। বরং ইসলামের আবির্ভাবকাল থেকেই শুরু হয়েছে তাদের এই জ্ঞানচর্চার কার্যক্রম।
ইসলাম আবির্ভাবকালে পৃথিবী যখন ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন পল্লীতে, তখন হযরত মুহাম্মাদের (সঃ) ওপর প্রভুর প্রথম বাণী এল 'পড়'।
ব্যাস, সেই থেকে শুরু। ইসলাম মানবজাতিকে মুক্তির পথ বলে দিল। একটাই পথ, মুক্তি পেতে চাও? তবে পড়, পড় এবং পড়।
আল্লাহর কাছ থেকে অদৃষ্ট হবার পর রাসূল (সঃ) শুরু করলেন অন্ধকার পৃথিবীকে আলোকিত করবার। এজন্য প্রথমেই তিনি নজর দিলেন একদল শিক্ষিত শিষ্য তৈরির দিকে।
তাই তিনি ঘোষণা দিলেন, যে জাতির কলম যত শক্তিশালী সে জাতি তত প্রতিষ্ঠিত ও উন্নত হতে পারে।
ঘোষণা দিয়েই তিনি বসে থাকেননি। মক্কার কাফেরেরা মুসলিমদের মদীনা আক্রমণ করলে বদর যুদ্ধে তার নেতৃত্বে কাফেরদের পরাজিত করা হয়। এ সময়ে বন্দী হওয়া অনেক কাফেরকে আল্লাহর রাসুল মুক্তি দিয়েছেন এমন এক শর্তে যা বিশ্বের ইতিহাসে কেবল প্রথমই নয়, বরং এটা বিরল এক ঘটনা। সেটি হচ্ছে, নবীর যেসব সাথী লেখতে ও পড়তে জানেন না, তাদের ১০ জনকে লেখাপড়া শেখাতে পারলে একজন বন্দী মুক্তি পাবেন। এটা ছিল যারা শিক্ষিত তাদের জন্য মুক্তির একমাত্র শর্ত।
এভাবেই রাসুল (সঃ) প্রতিষ্ঠা করলেন আসহাবে সুফফা নামে এমন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেখানকার শিক্ষার্থীরা খেয়ে না খেয়ে কেবলমাত্র জ্ঞানচর্চার জন্যই মসজিদে নববীতে পড়ে থাকতেন।
এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আবু হোরায়রা (রাঃ)। যিনি নবীর মুখের কোন হাদীস শুনলে সাথে সাথে তা মুখস্ত করে নিতেন। যার কল্যাণে দেড় হাজার বছর পরও মুসলিমরা আজও ধর্মচর্চা করে আসছে।
এখানকার আরেক শিক্ষার্থীর নাম হযরত আনাস (রাঃ), যিনি রাসূলের আদেশ, নিষেধ ও উপদেশগুলো লিখে রাখতেন৷ আবার লেখার মধ্য কারেকশন আছে কিনা দেখবার জন্য তা রাসুলকে (সঃ) পড়ে শোনাতেন।
বিশ্বনবী যখন সাহাবীদেরকে শিক্ষিত করে সেখান থেকে ২৬ জনকে মক্কায়, ৫১ জনকে কুফায়, ১৬ জনকে মিসরে, ৬ জনকে খোরাসানে এবং ৩ জনকে জাযীরায় পাঠিয়ে দিলেন সেখানকার অধিবাসীদের শিক্ষিত করবার জন্য [সূত্রঃ হাদীসের তত্ত্ব ও ইতিহাস]
এরপর রাসুলের মৃত্যুর পর তার প্রিয় সাহাবীদের হাত ধরে এই কার্যক্রমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যায়। আলী (রাঃ) কুফায় প্রতিষ্ঠা করেন লাইব্রেরী ও জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস যখন মারা যান, তখন তার কাছে ছিল এক বোঝা বই। যা একটি বড় উটে বইয়ে নিয়ে যেত কষ্ট হত।
সে সময়ের মুসলিম শাসকদের রাষ্ট্রীয় খরচের অন্যতম খাত ছিল জ্ঞানচর্চা ও লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা। লাইব্রেরীয়ানদের যে বেতন ছিল তা সে সময়ের বড় বড় সরকারি আমলারাও পেত না।
সে সময়ের গড়া আল হাজার লাইব্রেরীটা আজকের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়।
তখনকার মুসলিম শাসকেরা জ্ঞানচর্চা নিয়ে প্রতিযোগীতা করতো। কে, কার চেয়ে বড় লাইব্রেরী বানাবেন তার প্রতিযোগিতা।
তাদের গড়া লাইব্রেরীগুলোতে হাজার হাজার বই থাকতো। আর এসব লাইব্রেরীর ছাত্ররাই হয়েছিলেন একেকজন জাবের ইবনে হাইয়ান, আলবিরুনী, আল খারেজমি, বাইহাকী, মুজাম আল উবাদা, ওমর খৈয়াম, ইবনে বতুতা, ইবনে সিনার মত জগৎ বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা।
তারা একই সাথে যেমন ছিলেন বিজ্ঞানী, তেমনি দার্শনিক, ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ তেমনিভাবে রণাঙ্গনের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা। আর সবই সম্ভব হয়েছে জ্ঞান চর্চার কারণে।
কিন্তু আজ কোথায় সেই জ্ঞানচর্চা, কোথায় সেই বই পাগল মুসলিম জাতি?
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন