বই রিভিউ: যে বইগুলো বদলে দেবে আপনার চিন্তধারা
সব খারাপের মধ্যেও ভাল কিছু আছে। করোনায় লক ডাউনের এই সময়ে বই পড়ার সেই পুরনো অভ্যাসটা ফিরিয়ে আনার চ্যালেঞ্জ নিলাম। একটা সময় ছিল, যখন দু'চার জন বন্ধু মিলে একটা দিন বা কিছু সময়ে নির্দিষ্ট বই পড়ে পরে সেটা নিয়ে আলোচনা করতাম। ২০১০'র পর সেটা আর হয়ে ওঠেনি। এখন ওসব বন্ধুদের কে, কোথায় আছে সে খবরও রাখতে পারিছি না। তবে ফেসবুকে দেখা হয়, কিন্তু সেটা পোস্টের লাইক, কমেন্ট পর্যন্তই।
এরপরে অবশ্য কয়েকজন ব্লগার মিলে তেমন একটা গ্রুপ করেছিলাম। মাঝেমধ্যে ওভাবে করতাম। কিন্তু ২০১৩'র শাহবাগ আর মতিঝিলের চাপে সেটাও নষ্ট হয়ে গেছে। এরপর বই পড়া ছিল ব্যক্তিগত পর্যায়ে। কিন্তু আগের মত নেশা ছিল না তেমন। আগে এমনও হয়েছে, মাসে তিন-চার হাজার পৃষ্ঠা পর্যন্ত বই পড়ে ফেলতাম অনায়াসে।
যাই হোক, করোনাভাইরাস আগের মত অভ্যাসটা ফিরে পেতে সহায়ক হয়েছে। গত ২২ তারিখ থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২০০০ পৃষ্ঠার মত বই পড়েছি। তবে এবারের বই পড়ার ধরণটা ভিন্ন।
আচ্ছা আমরা পৌত্রিকসূত্রের মুসলিমরা তো মোটামুটিভাবেই ইসলামকে জানি, কিন্তু যারা Converted Muslim আছেন তাদের চোখে ইসলাম ধর্মটা কেমন? কোন আকর্ষণে তারা তাদের সব ফেলে আল্লাহ ও রাসূল (স.) এর প্রতি বিশ্বাসী হয়েছেন? বুক শেল্ফের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবনাটা হঠাৎ করেই উদয় হল মাথায়।
ভাবনার সাথে সাথে কাজ শুরু করে দিলাম। বুক শেল্ফ হতে নামিয়ে নিলাম ছ'টি বই। সেগুলো হল,-
(১) মক্কার পথ (The Road To Mecca) -মুহম্মদ আসাদ,(২) ফ্রম এমটিভি টু মক্কা (From MTV To Mecca) -ক্রিস্টিয়ানা বেকার,(৩) বাইবেল কুরআন ও বিজ্ঞান (The Qur'an and Modern Science) -ড. মরিচ বুকাইলি,(৪) ইন দ্য হ্যান্ড অব তালেবান (In the Hands of the Taliban)- ইভনি রইডলি,(৫) আমি কেন ইসলাম গ্রহণ করলাম -মাওলানা আবুল হোসেন ভট্টাচার্য, এবং(৬) আমি কেন খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করলাম না- মাওলানা ভট্টাচার্য। লেখকদের সবাই Converted মুসলিম।
[১]মক্কার পথ বা The Road To Mecca বইয়ের লেখক হচ্ছেন, মুহম্মদ আসাদ। যার ইসলামপূর্ব নাম ছিল লিওপোল্ড লুইস। ইহুদী রাব্বি (ইহুদিদের ধর্মীয় পন্ডিত) পরিবারের সন্তান লুইসের জন্ম জার্মানিতে। জগত-বিখ্যাত ফ্রাংকফুর্টার সাঁইটুম পত্রিকার মধ্যপ্রাচ্যে প্রতিনিধি ছিলেন। সেখানে আরবদের সংস্পর্শে এসে ২৭ বছর বয়সে সস্ত্রীক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
ইসলাম গ্রহণের আগে লুইস ঘুরে বেড়িয়েছেন আরব দেশগুলোর জনপদের মাঝে। সেখানে তিনি কুরআন ও ইসলামের বাণীর সাথে মুসলিমদের জীবনাচরণ মিলিয়ে দেখেছেন। তারপর গভীর অধ্যয়ন করেই মুসলিম হয়ে তিনি হয়ে যান ইসলামের পন্ডিত মুহাম্মদ আসাদ।
[২] বিশ্বখ্যাত মিউজিক টিভি MTV'র যাত্রার পর ইন্ডাস্ট্রিতে মিউজিকের সংজ্ঞাটাই বদলে যায়। ক্রিস্টিয়ানা বেকার ছিলেন এমটিভি ইউরোপের একজন ভিডিও জোকি। ৯০'র দশকে এমটিভির যাত্রাকাল থেকেই তিনি এতে যুক্ত হোন। চোখ ধাঁধানো গ্ল্যামার, আকর্ষণীয় ইমেজ আর সাবলীল উপস্থাপনার মাধ্যমে তিনি এবং এমটিভি পৌঁছে যায় ইউরোপের ঘরে ঘরে। ক্রিস্টিয়ানা হয়ে ওঠেন তরুণদের স্বপ্নের রানী। সে সময়ের স্টার, সুপারস্টারদের সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য ছুটে বেড়িয়েছেন ইউরোপ-আমেরিকায়। এমটিভি কর্তৃপক্ষও স্বীকার করে যাদের কারনে চ্যানেলটি জনপ্রিয়তা পায়, তাদের মধ্যে ক্রিস্টিয়ানা অন্যতম। যেখানেই যেতেন মানুষ ছুটে আসতো তার অটোগ্রাফের জন্য।
এত জাঁকজমক আর খ্যাতির মধ্যে থেকেও ক্রিস্টিয়ানার ভেতরে কিছু একটার অভাব ছিল প্রকট। কিসের শুণ্যতা যেন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল তাকে। এরমধ্যেই তার সাথে পরিচয় হয় পাকিস্তানের বিশ্বকাপজয়ী নায়ক (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) ইমরান খানের সঙ্গে। তার আহবানে তিনি পাকিস্তান বেড়াতে যান কয়েকদিনের জন্য। সেখানে ইমরান খানের ধর্মীয় ভাবধারা ও ব্যক্তিত্বের পাশাপাশি পাকিস্তানিদের ইসলামী অনুশাসন এবং আল্লামা ইকবালের লেখা ও ওস্তাদ নুসরাত ফাতেহ আলী খানের গান তাকে ইসলামের প্রতি আকর্ষণী করে তোলে।
এক পর্যায়ে ক্রিস্টিয়ানা যখন ইসলাম গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন ইমরান তাকে ছেড়ে চলে যান। ভালবাসা হারানোয় ভেঙ্গে পড়লেও ইসলামের প্রতি তার আকর্ষণ একটু কমেনি, বরং বেড়েছে। এরপর আরো গভীরভাবে অধ্যয়নের পর তিনি ১৯৯৬ সালে ইসলাম গ্রহণ করেন।
ইসলাম গ্রহণের পর তার পৃথিবী অনেক ছোট হয়ে যায়। চারদিকে তুমুল হৈচৈ পড়ে যায়। জার্মানির ব্রাভো টিভি ও এমটিভির চাকুরী হারান। এছাড়াও পদে পদে মুসলিম নামধারী কিছু মানুষের কাছ থেকে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন কয়েকবার। তারপরও তিনি থেমে থাকেননি। ছুটে চলেছেন অবিরাম সত্যের পথে।
[৩] ড. মরিচ বুকাইলির বাইবেল, কুরআন ও বিজ্ঞান হচ্ছে জগত বিখ্যাত একটি বই। আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে বাইবেল ও কুরআনের অসঙ্গতি খুঁজতে গিয়ে কুরআনের বর্ণনার মিল খুঁজে পেয়ে যান বিখ্যাত ফ্রেঞ্জ চিকিৎসক বুকাইলি। তার লেখা বইটি পবিত্র কুরআনের বানীকে কেবল বিজ্ঞানের আবিষ্কারের নয় বরং এর কোন মানবীয় ব্যাখ্যাতেই হতে পারে না বলে স্বীকৃতি দেন।
[৪] ২০০১ সালে টুইনটাওয়ারে হামলার সময় ইভন রিডলি (Yvonne Ridley) কাজ করছিলেন ডেইলি এক্সপ্রেসের বার্তা কক্ষে। এর আগে তিনি কাজ করেছিলন The Sunday Times, The Independent on Sunday, The Observer, Daily Mirror, Time এবং News of the the World -এর মত বিখ্যাত সব পত্রিকায়।
টুইনটাওয়ারে হামলার কয়েকদিন পর তিনি সংবাদ সংগ্রহের জন্য পাকিস্তানে ছুটে আসেন। এরমধ্যে আফগানিস্তান থেকে সব বিদেশি সাংবাদিককে বহিষ্কার করা হয়। একদিন রিডলি বোরকা পড়ে ছদ্মবেশে ঢুকে পড়েন আফগানিস্তানে। সেখানকার নারীদের বর্তমান অবস্থা, অশিক্ষা ও নির্যাতন এবং আসন্ন যুদ্ধের প্রেক্ষিত তুলে আনাই ছিল তার উদ্দেশ্য। ফিরে আসার সময় তালেবানের হাতে তিনি আটক হন। তার বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির আভিযোগ আনে তালেবান। ১০ দিন বন্দী থাকার নানাবিধ চাপে মোল্লা ওমরের বিশেষ আদেশে তাকে মুক্তি দেয়া হয়।
বন্দী অবস্থায় তালেবানদের সংস্পর্শে এসে তার প্রতি (নারীদের প্রতি) তার সম্মান তাকে পুলকিত করে। ভেঙ্গে যায় ইসলাম ও তালেবানদের প্রতি নারী নির্যাতনের তার ভুল ধারণা।
ভুল ভাঙ্গার পর তিনি ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন এবং দুই বছর পর ২০০৩ সালে তিনি ইসলাম গ্রহের করেন।
[৫-৬] সুদর্শন ভট্টাচার্যের জন্ম বর্তমান বাংলাদেশের শরীয়তপুর জেলায় ১৯১৬ সালে একটি হিন্দু পুরোহিত পরিবারে। পাঠশালার এক মুসলিম শিক্ষক আদর করার কারনে জাত চলে যাওয়ায় জামাকাপড় সহ গোসল করিয়ে বাড়িতে ঢুকতে হয় তাকে। এটা তার ছোট মনে দাগ কাটে। এরপর হিন্দু ধর্মের বহুইশ্বর প্রথা তার ছোট বেলা থেকেই মনে প্রশ্ন জাগে। এরপর বিভিন্ন ধর্মের গভীর অধ্যয়নের পর ১৯৩৭ সালে ২১ বছর বয়সে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।
সে সময়ে হিন্দু প্রভাবাধীন বৃটিশ ভারতে তার ইসলাম গ্রহণ কাল হয়ে দাঁড়ায়। হিন্দু মৌলবাদীরা তাকে হত্যা ও গ্রেফতার করবার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে যায়। নানা ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেই তাকে এগিয়ে যেতে হয়। মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে ইসলামের উপর পান্ডিত্য অর্জন করেন। সব কিছুও আছে তার লেখা 'আমি কেন ইসলাম গ্রহণ করলাম' এবং 'আমি কেন খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করলাম না' বই দুইটিতে।
এই বইগুলো পড়ে যেমন অবাক হয়েছি, তেমনি লজ্জাও লেগেছে। উত্তরাধিকারসূত্রে মুসলিম হয়েও ইসলাম, কোরআন ও আল্লাহকে নিয়ে এমন ভাবনা, আবেগ এবং নিখাদ ভালবাসা আগে অনুভব করতে পারিনি। তাদের লেখাগুলো যেমন উদ্দীপনা জন্মায় তেমনি লজ্জাও পাইয়ে দেয়। চোখে আঙুল দিয়ে ইসলামের সুমহান আদর্শ চিনিয়ে দিয়েছেন তারা।

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন