প্রসঙ্গ, রাজা জালালুদ্দিন দ্বারা ব্রাহ্মণদের গোমাংস ভক্ষণঃ যে সত্যটি গোপন করলেন শ্রীবিনয়

ভারতীয় একজন ইতিহাস লেখক আছেন, নাম শ্রীবিনয় ঘোষ। তার লেখা বইগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে, 'ভারতজনের ইতিহাস '। এই বইটি সম্ভবত ভারতে কলকাতা রাজ্যের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়।

এই বইয়ের এক জায়গায় আছে, রাজ্যটির উত্তরবঙ্গে তৎকালীন একজন রাজা ছিলেন জালালুদ্দিন। ১৪১৮ সালে তিনি সিংহাসনে বসার পর ব্রাহ্মণদের গরুর মাংস খেতে বাধ্য করেছিলেন...।

ভারতে মুসলিম বিদ্বেষের কারণগুলো খুঁজতে গিয়ে বুঝলাম শ্রীবিনয় এই বইয়টির অনেকাটা ভুমিকা রয়েছে । এই বইয়ের অনেক স্থানেই ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যা বা ভুল ইতিহাস চিত্রিত হয়েছে। বুঝুন, যদি বর্তমান কট্টর মানুষিকতার হিন্দুরা পড়ে যে, আগেরকালের মুসলিম রাজারা হিন্দু ব্রাহ্মণদের গরুর মাংস খেতে বাধ্য করতেন, তাহলে তারা করোনায় মুসলিমদের হাসতালে চিকিৎসা নিতে দিবে কেন?

অবশ্য রাজা জালালুদ্দিন যে ব্রাহ্মণদের গরুর মাংস খেতে বাধ্য করেছিলেন, সেটা সত্য। কিন্তু এই রাজা জালালুদ্দিন কে, কেন তিনি সেটা করেছেন তা শ্রীবিনয় এড়িয়ে গেছেন সুকৌশলে।

বাস্তবের ইতিহাস কিন্তু খুব ইন্টারেস্টিং। রাজা জালালুদ্দিন ১৪১৮ সালে সিংহাসনে বসেন। এর আগে সিংহাসনে ছিলেন তার বাবা দনুর্জন। তিনি আবার রাজা কংস এবং রাজা গণেশ নামেও ইতিহাসে পরিচিত। রাজা দনুর্জন ছিলেন কট্টর মুসলিম বিদ্বেষি।

মুসলিমদের বিশেষকরে যারা ইসলাম প্রচার করতো এবং সুফী সাধক ছিলেন তাদের খুব অত্যাচার-নির্যাতন করতো রাজা দনুর্জন। সেখানে কুতুবুল আলম নামে একজন জনপ্রিয় সুফি ছিলেন। তাকেও রাজা নির্যাতন করেন।

সে সময়ে জৌনপুর রাজ্যের রাজা ছিলেন ইব্রাহিম শাহ। তিনি আবার সুফি কুতুবিল আলমের ভক্ত ছিলেন৷ তার নির্যাতনের কাহিনী শুনে এবং সেখানকার মুসলিমদের কাছ থেকে বাঁচানোর আকুতি জানিয়ে পত্র পাবার পর রাজা ইব্রাহিম শাহ রাজা কংস বা গণেশের বিরুদ্ধে সেনা অভিযানের ঘোষনা দিলেন।

রাজা কংস যখন বুঝলেন, তিনি ইব্রাহিম শাহের বিরুদ্ধে লড়াই করে জিততে পারবেন না, তখন তিনি ঘোষণা দিলেন, ইসলাম বা মুসলমানদের সাথে তার কোন বিরোধ নেই। প্রমাণ হিসেবে তিনি তার পুত্র যদুকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিয়ে সিংহাসন তার কাছে হস্তান্তর করেন।

রাজা কংসের অঘোষিত ক্ষমা, পুত্রের ইসলাম গ্রহণ এবং সিংহাসনে সন্তুষ্ট হয়ে ইব্রাহিম শাজ জৌনপুরে ফিরে যান।

রাজা ইব্রাহিম চলে গেলে রাজা গণেশ আপন খোলসে বের হন। তিনি পুরোহিতদের ডাকলেন পুত্র যদুকে ফের হিন্দুধর্মে ফেরত নেবার জন্য।

পুরোহিত ব্রাহ্মণেরা রাজা গণেশকে জানালেন, এ জন্য রাজাকে 'স্বর্ণ ধেনু ব্রত' পালন করতে হবে। অর্থাৎ, একটা স্বর্ণের গাভী তৈরী করে ব্রত পালনের পর সেই স্বর্ণগুলো ব্রাহ্মণদের ভাগ করে দিতে হবে। তাই করা হল। যদু আবার হিন্দু হয়ে গেলেন।

এদিকে মুসলিম থেকে আবার হিন্দু হলেও যদু ম্লেচ্ছ হয়ে যান। হিন্দুরা তাকে মন থেকে হিন্দু হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। আর ব্রাহ্মণরাও এই বিদ্বেষে ভুমিকা রাখে।

এ দিকে রাজা কংস বা গণেশ কিংবা দনুর্জন মারা যায়। যদু আবার রাজা হন। এইবার রাজা ব্রাহ্মণদের বৈষম্যকে আচরণে ক্ষোভে সত্যি সত্যি ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। এবার তিনি মুসলিম হয়ে নাম ধারণ করেন জালালুদ্দিন নামে।

মুসলিম হয়ে তিনি সেই ব্রাহ্মণদের উপর প্রতিশোধ নিতে চান। এজন্য তিনি তাদের নিমন্ত্রণ করেন। খাবার হিসেবে তাদের জন্য গো মাংসের ব্যবস্থা করেন।

গো মাংস খেতে ব্রাহ্মণরা আপত্তি জানালেন। তখন রাজা জালালুদ্দিন কড়া ভাষায় জানিয়ে দিলেন এটা তাদের খেতেই হবে।

স্পষ্ট ভাষায় তিনি জানিয়ে দিলেন, সোনার গরু ভাগ করে যদি ঝাওয়া যায়, তবে আসল গরুও ব্রাহ্মণদের খেতেই হবে।

মূলত, রাজা জালালুদ্দিন তার প্রতি যে অভিচার ব্রাহ্মণরা করেছেন, তার একটা উচিত শিক্ষা তাদের দিয়েছেন। এইটা এক ধরণের প্রতিশোধও।

অথচ শ্রীবিনয় ইচ্ছেকৃতভাবেই এ বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। সে সময়ে কোন মুসলিম হিন্দুদের অত্যাচার করেননি। যারা করেছেন, তারা হিন্দু ধর্ম কর্তৃক অবক্ষার শিলার হগে ধর্ম ত্যাগ করে আসা নতুন মুসলিমরা করেছিল প্রতিশোধ বা বদলা হিসেবে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাংলা চলচ্চিত্রের সংকট ও সীমাবদ্ধতাঃ দুইটি বাংলা চলচ্চিত্রের পর্যবেক্ষণ ও তুলনামূলক পর্যালোচনা

কথাগুলো 'সাম্প্রদায়িক'

Coverage of Local Development Issues in Regional Newspaper of Chattogram