সংস অব ব্লাড এন্ড সোর্ড: অভিশপ্ত এক পরিবারের আখ্যান
‘সংস অব ব্লাড এন্ড সোর্ড’ এমন এক পরিবারের
অভিশপ্ত আখ্যান, যে পরিবারের দুই প্রজন্মের কোন পুরুষকে জীবিত থাকতে দেয়া হয়নি। কারো
মৃত্যু হয়েছে ফাঁসীতে ঝুলে, কেউ আততায়ীর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে আবার কেউবা বিষ প্রয়োগে
মৃত্যুর বরণ করেছেন। এমনটাই হওয়ার কথা। কারন লাখো লাখো মানুষের অভিসম্পাত যে আছে এই
পরিবারের ওপর।
কথায় আছে পাপ বাপকেও ছাড়ে না। আপনি যত বড় ক্ষমতাধরই হন না কেন, ভুলের
প্রায়শ্চিত্ত আপনাকে করতেই হবে। আমাদের এই উপমহাদের রাজনীতিকদের জীবনভাগ্য পেন্ডুলামের
মত ঝুলে থাকে বুলেটের নীচে। গত শতাব্দিতে এখানকার দেশগুলোতে ক্ষমতায় ছিল যে ক’টি পরিবার, তার
প্রায় সব ক’টিই হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান,
নেপালসহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশেই হয়েছ বিদ্রোহ। বুলেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন,
নিহত হয়েছেন শাসকেরা।
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে তাদের ভুল বা পাপের পাল্লা কোন না কোন ভারি হয়ে
আছে। যার ফলশ্রুতিতে মৃত্যু তাদের অনিবার্য হয়ে যায়। এদের মধ্যে মুজিব, জিয়া, গান্ধি,
ভুট্টো, জ্ঞানেন্দ্রো উল্লেখযোগ্য। তবে তাদের মধ্যে ভুট্টো নামটি গুরুত্বের দাবীদার।
এটি পাকিস্তানের প্রভাবশালি ঘোষ্ঠিগুলোর অন্যতম। জুলফিকার আলী ভুট্টো এই পরিবারেরই
সন্তান।
জমিদার পরিবারের ছেলে, রাজনীতিকেও জমিদারির পর্যায়ে মনে করাটাই ছিল তার
সবচেয়ে বড় ভুল। এই ভুলটিই তাকে এমন এক পাপের প্রতি ধাবিত করে, যার প্রায়শ্চিত্ত করতে
হয়েছে তাকে, তার পরিবারকে। এর শেষ কখন হবে সেটি বলা যাচ্ছে না। ভুট্টোর মহাপাপের ফল
ভোগ করতে হচ্ছে আজও তার পরিবারকে।
১৯৭১ সালে এই ভুট্টোর একঘুঁয়েমীর কারেনেই ভয়ঙ্কর এক যুদ্ধ বেঁধেছিল।
লাখো লাখো মানুষ মারা গিয়েছিল তার ক্ষমতা লিপ্সার কারনে। ৭০’র নির্বাচনে হেরে
গিয়েও তিনি ক্ষমতা দখলের মত্ততায় মেতে ছিলেন। শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধা হয়েছিলেন।
যার কারনে আজ আমরা স্বাধীন একটি দেশ পেয়েছি। তবে এই দেশ পাওয়াটা অল্প দামে কেনা যায়নি।
লাখ লাখ মানুষের রক্ত ঝরেছে এই যুদ্ধে। এই যে মানুষের আর্তনাদ, মনের ক্ষত; সেটি কি
এমনিতেই সেড়ে যাবে? সৃষ্টিকর্তা কি তাদের পাকড়াও করবেন না? অবশ্যই করবেন, এবং করেছেনও।
![]() |
| জুলফিকার আলী ভুট্টো |
বাংলাদেশ স্বাধীনত হওয়ার পর ভুট্টো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছিলেন।
কিন্তু বেশিদিন ভোগ করতে পারেননি ক্ষমতার স্বাদ। দেশ ভেঙ্গে ক্ষমতারোহনের ছয় বছর পর
১৯৭৭ সালের ৪ জুলাই তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে বন্ধি করেন তারই নিয়োজিত সেনাপ্রধান জেনারেল
জিয়াউল হক।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এর মাত্র কয়েক মাস আগেই পাঁচজন সিনিয়রকে ডিঙ্গিয়ে
জেনারেল জিয়াউলকে সেনাপ্রধান করেছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। কারন পবিত্র কোরআন ছুঁয়ে
তার বশ্যতা স্বিকার করেছিলেন জিয়াউল হক। এতটাই অনুগত ছিলেন তিনি কখনোই মাথা উঁচু করে
কথা বলতেন না ভুট্টোর সামনে। একবার তো সিগারেট খাচ্ছিলেন জিয়াউল। ও সময়ে হঠাৎ করে ভুট্টো
কোথাও থেকে চলে এলে উপায়ান্ত না দেখে তিনি সেই সিগারেট ইউনিফর্মের পকেটে লুকিয়ে ফেলেন।
আর তাতে তার ইউনিফর্ম পুড়ে ধোঁয়া বের হতে থাকে।
![]() |
| সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হক |
অথচ কয়েক মাস পরেই এই জিয়াউল হক ঘোষণা করলেন, ‘দুইজন মানুষ,
কফিন একটা; হয় আমি না হয় সে (জুলফিকার)’। ঠিকই, তার দুই
বছর পর ১৯৭৯ সালের ৪ এপ্রিল তাকে ফাঁসীতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। এখানেই হয়তো শেষ হতে
পারতো, কিন্তু না; এই পরিবারের দায় অনেক। তাই তাদেরকে বইতে হয়েছে আরো কয়েকটি লাশের
কফিন। হত্যা করা হয় তার চার সন্তানের তিনজনকেই।
১৯৮৫ সালের ১৮ জুলাই ফ্রান্সের নিস শহরের একটি হোটেলে মৃত অবস্থায় পাওয়া
যায় জুলফিকার আলী ভুট্টোর ছোট ছেলে শাহনেওয়াজ ভুট্টোকে। তার লাশটি নীল বর্ণ ধারণ করা
ছিল। ভয়ঙ্কর বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে তাকে হত্যা করেছে অজানা আততায়ী।
এরপর ১৯৯৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর করাচিতে ছয়জন দেহরক্ষিসহ হত্যা করা হয়
তার বড় ছেলে মুর্তজা ভুট্টোকে। অথচ সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তার মেয়ে ও মুর্তজার
এক বছরের বড় বোন বেনজির ভুট্টো। এর আগে অনেক গোপনে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান হয়ে নির্বাচনের
জন্য দেশে আসেন মুর্তজা। তার বাবার মৃত্যুর পর আর কখনোই দেশে আসা হয়নি। বিভিন্ন দেশ
ঘুরে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল আসাদের (বাসার আল আসাদের বাবা) আশ্রয়ে ছিল তার পরিবার।
মুর্তজা ভুট্টোর মেয়ে ফাতিমা ভুট্টো তার বাবার মৃত্যুর জন্য ফুফু বেনজির ভুট্টো ও তার
স্বামী আসিফ আলী জারদারিকে দায়ি করে
আসছেন বারবারে।
সর্বশেষ ২০০৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে এক নির্বাচনী
সমাবেশে গুলি বর্ষণে হত্যা করা হয়। মৃত্যুর পর তার দল পিপিপি সরকার গঠন করে। মনে করা
হয়, নিহত না হলে দ্বিতীয় বারের মত ক্ষমতায় বসতেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।
বর্তমানে ভুট্টো পরিবারের মাত্র দুইজন পুরুষ (জুলফিকার আলী ভুট্টোর নাতি)
জুলফিকার জুনিয়র ও মির আলী বেঁচে আছে। তার বাহিরে এই পরিবারের সদস্য হিসেবে তাদের বোন
ফাতিমা ভুট্টো ও শশী ভুট্টো বেঁচে আছেন। এদের মধ্যে ৩৬ বছরের ফাতিমা ভুট্টো সবার বড়।
লেখালেখি করলেও রাজনীতি থেকে দূরে রয়েছেন।
ভুট্টো পরিবারের রক্তাক্ত আখ্যানটি রচনা করেলেও মূলত ফাতিমা ভাট্টি তার ‘সংস অব ব্লাড এন্ড সোর্ড’ বইতে একজন বাবার প্রতি মেয়ের ভালবাসার বহিপ্রকাশ করেছেন। যে পিতা মাত্র ১০ বছরের কণ্যার সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, পিতৃ হত্যার জন্য এই বালিকা সব সময়ই দায়ি করেছেন নিজ ফুফুকে, যিনি নিজেও হত্যার শিকার হয়েছেন।
![]() |
| বেনজির ভুট্টো |
বইটিতে ফাতিমা তার পরিবারের ইতিহাসের পাশাপাশি পাকিস্তানের রাজনীতির
প্রতিচ্ছবি বর্ণনা করেছেন। ২০১০ সালের লেখা বইটির হৃদয় বিদারক, ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক
সমালোচনার সন্নিবেশ। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টিও অনেকটা উদারভাবে আলোচনা করেছেন
তিনি এই বইতে। সমালোচনা করেছেন পাকিস্তানি সৈন্যদের হত্যা, নির্যাতন ও ধর্ষণের। দুইটি
অধ্যায়ে তাদের পরিবারের কিছু দুর্লভ ছবির পাশাপাশি পিতা-কণ্যার একান্তে কাটানো কিছু
ফ্যামেলি ফটোও রয়েছে এতে।
অসাধারণ সাহিত্য মানের বইটি পারিবারিক ইতিহাস এতো সুন্দরভাবে বর্ণনা
করাটা ফাতিমা ভুট্টোর বাহিরে কেউ পারতেন কিনা সন্দেহ রয়েছে। উইলিয়াম ড্যালরিম্পল বইটির
ব্যাপারে বলেছেন, “কেউ যদি এই আখ্যান লেখার জন্য জন্মগ্রহণ
করে থাকেন তিনি ফাতিমা ভুট্টো”। এটিকে একটি অনবদ্য উপখ্যান আখ্যা দিয়ে
খুশবন্ত সিং বলেছেন, ‘Written in impeccably beautiful
prose...gusty’.
পেঙ্গুয়েন থেকে প্রকাশিত মূল বইটি কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বাংলা
ভাষাতেও এই প্রকাশ করেছে অঙ্কুর প্রকাশনী। অনুবাদ করেছেন জয়নাল আবেদিন। কিছু ছোটখাট
ভুলের বাহিরে মানসম্মত অনুবাদই হয়েছে।
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ার পর আপনাতেই মন বলে উঠবে সত্যিই এটি একটি
“সংস অব ব্লাড
এন্ড সোর্ড”।







মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন