'মায়ের বিয়ে' এবং আমাদের সমাজ
কয়েকদিন আগে পরিচিত একজনের সাথে দেখা হল। কথা বলার এক পর্যায়ে সে বলল ‘ভাই, আমি আপনাকে দাওয়াত দিতে এসেছি। কাল আমার আব্বুর বিয়ে। আপনাকে যেতে হবে’। প্রথমে ভেবেছি সে দুষ্টুমি করছে। পরে বুঝলাম বিষয়টি সত্যি। তাই অবাক হলাম। কারন ছেলের কাছ থেকে বাবার বিয়ের দাওয়াত জীবনে কেবল প্রথমই নয়, বরং শুনেছিও প্রথম।
বিষয়টি আমাদের ভাবনার চেয়ে বাস্তবাতায় অনেক বেশি কঠিন। বছর কয়েক আগের ঘটনা, পরিচিত এক নারী বয়স ৪৫’রে বেশি হবে না; দুই সন্তানের মধ্যে মেয়ে বিয়ে করে শ্বশুর বাড়িতে আর একমাত্র ছেলে লন্ডন প্রবাসী, বিয়ে করে সেখানেই থিতু হয়ে রয়েছেন। একাকীত্ব জীবনের এক পর্যায়ে কোন এক বিপত্নিক পুরুষের সঙ্গে বিয়ে করেছেন। কিন্তু তার বিয়েটি মোটেও সহজতর ছিল না। ছেলে-মেয়ের কেউই বেপারটি শুরু থেকে মেনে নিতে পারেননি। একমাত্র মেয়ে জামাই শ্বাশুড়িকে Support দিয়েছেন। এ কারনে তার সংসারও ভাঙ্গণের মুখে পড়ে।
প্রায় এক বছর প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলার পর সেই নারী বিয়ের পীড়িতে সবতে পেরেছেন। অবশ্য এ কারনে তাকে ছেলে ও মেয়েকে হারাতে হয়েছে। তারা আর মায়ের সাথে সম্পর্ক রাখে না। তবে মেয়ের জামাই তার খোঁজ খবর রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার জন্য তাকে তার নিজের বাবা-মায়ের তিরষ্কার গুনতে হচ্ছে। ছেলের বিধবা শ্বাশুরি দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন, এ কারনে নাকি সমাজে তাদের মুখ দেখাতে পারছেন না!
আসলে দোষ আমাদের নয়, সমাজের। কারন আমাদের সমাজে দ্বিতীয় বিয়ের প্রচলন খুব একটা নেই। বরং এটি এক ধরনের অঘোষিত নিষিদ্ধ। একজন পুরুষ ও নারীর যৌবিক চাহিদা মেটানোর বৈধ এবং স্বাভাবিক পদ্ধতি হচ্ছে বিয়ে। ধর্মীয় কারন ছাড়াও আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় এটি গুরুত্বপূর্ণ। বিয়ে বহির্ভুত সম্পর্ক আমাদের সমাজ মেনে নেয় না।
কিন্তু বিপদ দেখা দেয় যখন কোন নারী বা পুরুষ মৃত্যু বা ডিভোর্সের কারনে সঙ্গিহীন হয়ে পড়েন তখন। ইচ্ছে ও প্রয়োজন থাকলেও সমাজ তার দ্বিতীয় সঙ্গি গ্রহণের বিষয়টি ভালভাবে নেয় না।
একবার আমাদের পরিবারের পরিচিত এক লোক এলেন আব্বার কাছে অত্যান্ত ভারাক্রান্ত মনে। উনি তার বাবার নামে অভিযোগ এনেছেন, বৃদ্ধ নাকি বিয়ে করতে চাচ্ছেন। কোন এক নারীর সাথে তার সম্পর্ক হয়েছে। বিষয়টির গুরুত্ব অনুভব করে আব্বা ষাটোর্ধ সেই বৃদ্ধের সাথে দেখা করলেন।
কিন্তু দেখা গেল বিষয়টি অন্য রকম। তার দুই ছেলে এবং মেয়ে রয়েছে। সবাই যে যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। বৃদ্ধ বাবার মৌলিক চাহিদা তারা মেটালেও এই বয়সে যে পরিমাণে তাকে সঙ্গ দেয়া প্রয়োজন তা কেউ তাকে দিচ্ছে না। তাছাড়াও বৃদ্ধ তার জামা কাপড় নিজেকে যেমন পরিষ্কার করতে হয়, তেমনি শারিরীক কোন সমস্য হলে সেটাও তাকে নিজেই করতে হয়। মূল কথা হচ্ছে, তার একজন সার্বক্ষণিক সঙ্গির প্রয়োজন, যা ছেলে-মেয়ে বা নাতি-নাতনি দ্বারা মেটানো সম্ভব নয়। কিন্তু তার পরিবার সমাজিক অবস্থা বিবেচনা করে সেটা মেনে নিতে পারছে না। এভাবে কয়েক বছর কাটানোর পর বৃদ্ধ মারা যান, কিন্তু বিয়ে তিনি করতে পারেননি।
আবার পরিচিত এক আংকেলকে জানি যার একজন অটিস্টিক মেয়ে রয়েছে। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর বেশ বিপদে রয়েছেন তিনি। কিন্তু সামাজিক অবস্থা বা প্রতিবন্ধকতার কারনে হয়তো দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে পারছেন না। কিন্তু একজন অসুস্থ মেয়েকে কি তার পক্ষে লালন সম্ভব?
এই দু’টো ঘটনার মত অনেক ঘটনা আমাদের চারপাশে ঘটছে। কিন্তু আমরা সেগুলো দেখেও চুপ থাকি বা পাশ কাটিয়ে যাই। কারন আমাদের সমাজ ব্যবস্থ একটা প্রতারণার ওপর দাড়িয়ে রয়েছে। যেখানে স্বামী-স্ত্রীর কোন একজন মারা গেলে অথবা ডিভোর্স হলে তার সাথে সাথে জীবিতজনের সকল আবেগ, ভালবাসা আর চাহিদারও মৃত্যু হয়। কিন্তু আসলেই কি মৃত্যু হয়? না, হয় না। কিন্তু তাকে নীরবে সইতে বাধ্য করছে সমাজ ব্যবস্থা। আর পরিবারের লোকেরা সেটা বুঝেও না বোঝার ভান করি সামাজিক অবস্থান বিবেচনা করে।
আমাদের মনোভাবকে বদলাতে হবে। কারন, যারা বিধবা কিংবা বিপত্নীক, তারাই জানেন তাদের প্রকৃত প্রয়োজন কী? সন্তান কিংবা পরিবারের লোকজন কেবলমাত্র তার মৌলিক প্রয়োজনগুলোই মেটাতে সক্ষ্ম, কিন্তু এর বাহিরেও তোবতার অনেক ধরনের চাহিদা রয়েছে, যা শুধুই সঙ্গী দ্বারাই সম্ভব, অন্য কারো মাধ্যমে নয়। অবশ্য কিছুটা দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো শুরু হয়েছে।
কিছু দিন আগে একটা নিউজ দেখলাম, ‘মায়ের বিয়ে নিয়ে উচ্ছ্বসিত ছেলেমেয়েরা’। হলিউড অভিনেত্রী এঞ্জেলিনা জোলি আবার বিয়ে করতে যাচ্ছেন। এজন্য তার ছয় ছেলে বেশ উচ্ছ্বসিত বলে খবর চেপেছে বাংলানিউজ। এটি ইতিবাচক। এবং এমনটিই হওয়া উচিত। সমাজের তৃতীয় নয়ন হচ্ছে মিডিয়া। মিডিয়া সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে এগিয়ে আসার অর্থ হচ্ছে মানুষের সচেতনতা তৈরী হওয়া। এভাবেই একদিন বদলানো যাবে দৃষ্টি ভংগি।
অবশ্য এজন্য কলকাতার সিনেমাপাড়াকেও সাধুবাদ জানাতে হয়। তারা একটা সাহসীকতার পরিচয় দিয়েছে। কয়েক বছর আগে সেখানে ‘মায়ের বিয়ে’ নামে একটি চলচ্চিত্র তৈরী হয়েছে। যেটি সত্যিই প্রশংসিত।
সিনেমার কাহিনীতে দেখা যায়, পিতৃহীন ও কলেজ অধ্যাপক মায়ের সন্তান হিসেবে বেড়ে ওঠা মেয়ের কখনো বাবার কথা মনে হয়নি। মায়ের আদরই যথেষ্ট ছিল মেডিকেল পড়ুয়া মডার্ণ এই মেয়ের। কিন্তু কোন এক সেমিনারে স্যোশাল রিলেশনের কথা বলতে গিয়ে বুঝতে পারে মায়ের অব্যক্ত একাকিত্বের কথা । ব্যাস তখন থেকেই নেমে পড়ে মায়ের যোগ্য সঙ্গি খোঁজার। অর্থাৎ নিজের মাকে বিয়ে দেয়ার কাজটি কি এত সহজ? তার ওপর এই বয়সে এসে যখন সন্তানকে বিয়ে দেয়ার কথা, তখন মেয়ে তার মাকে বিয়ে দেয়ার জন্য রণাঙ্গণে নেমেছে। আর আমাদের এই উপমহাদেশে নারীর দ্বিতীয় বিয়েটাতো এতটা সহজ ব্যপার নয়। তার ওপর সন্তান থাকলেতো আর নারীদের দ্বিতীয় বিয়ে সমাজ এবং মা নিজেই বিয়ে নিষিদ্ধ করে দেন।
সেখানে ‘মায়ের বিয়ে’ নিয়ে সিনেমা বানানো অনেকটা কঠিন বিষয়। কিন্তু এসকে মুভিজ প্রযোজিত সিনেমায় মায়ের ভূমিকায় অভিনেত্রী শ্রীলেখা মিত্র আর মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করা সায়নি ঘোষের দুর্দান্ত অভিনয়ে চলচ্চিত্রটি দারুণ হয়েছে।
তবে অভিজিৎ-সুদেষ্ণা নির্মিত এই সিনেমাটির থিম অসাধারণ হলেও বাণিজ্যিকিকরণ করতে শেষের দিকে উপমহাদেশীয় সিনেমার গতানুগতিকতা পরিহার করতে পারেননি। সমাজের মান রাখতে কিংবা হয়তোবা সিনেমাটিকে সমালোচনা মুক্ত রাখতে চিত্রনাট্যকার এক রকমের জোরপূর্বক সব্যসাচী চক্রবর্তীর প্লটটি নিয়ে এলেন। সিনেমার মাঝামাঝিতে মেয়ের (সায়নি ঘোষ) অধ্যাপক হিসেবে আবির্ভূত হন এবং সিঙ্গেল লাইফ মেন্টেইন করা এই প্রফেসরকে সায়নি তার মায়ের বর হিসেবে সিলেক্ট করে। এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল, কিন্তু শেষ পর্যায়ে দেখা গেল, এই লোকটিই সায়নির বাবা। যিনি ক্যারিয়ার গড়তে গিয়ে লিভ টুগেদার করতে থাকা সঙ্গিনিকে না বলেই বিদেশ চলে যান। অথচ সেই সময়ে তার সঙ্গিনী (শ্রীলেখা মিত্র) গর্ভবতী ছিলেন। ব্যাস, যা হওয়ার তাই হল। সিনেমায় ক্ল্যাশ ও ক্লাইমেক্স না থাকলে সিনেমা হয় না এটা তো এ্যারিস্টটল বলেই গেছেন। এগুলো পূর্ণ করেই মান অভিমান ভাঙ্গিয়ে সিনেমার সমাপ্তি টানা হল।
শেষের প্লটটি বাদ দিলে এই সিনেমাটি ভাল একটি সিনেমা ছিল। পরিচালক যদি বাস্তবিক অর্থেই তার সিনেমায় ‘মায়ের’ দ্বিতীয় বিয়ে দেয়ার সাহসিকতা দেখাতেন, তাহলে তার জন্য অনেক সাধুবাদ জমা হত। এটা অনেক কাজে দিত। কারন সিনেমাকে ধরা হয় সমাজের সবচেয়ে Effective tool হিসেবে। সে কারনেই এসব অঘোষিত বাধাগুলোকে ভাঙ্গবার জন্য সিনেমাকে বেছে নিতে হবে।

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন