‘বড় ছেলে’ এবং আমাদের নাটক নিয়ে কিছু কথা

সবার স্ট্যাটাসের জ্বালায় আর পারলাম না, তাই দেখে নিলাম টেলিফিল্ম ‘বড় ছেলে’। নাটকটা ভালই। তবে আরো ভাল হত, নায়কের নাম ‘রাশেদ’ না হয়ে ‘মামুন’ হলে। সম্ভবত সেখানে নায়িকার নাম কী হবে?, এ বিবেচনায় নাট্যকার এই নামটি দেননি :D
নাটকটা যে কারনে জনপ্রিয় হয়েছে সেটা বলা আগে কিছু কথা বলতে চাই। এটি দেখার পর এর নাট্যকার ও পরিচালক আরিয়ানের ওয়ালে গেলাম। যা দেখলাম, তাতে বুঝলাম তিনি এবারের ঈদে মোট দুইটি নাটক বানিয়েছেন। ‘বড় ছেলের’ মত আলোচিত না হলেও ওটিও নাকি ভাল হয়েছে।
সে যাই হোক, যা বলতে চাচ্ছিলাম তা হল,আমাদের দেশে বর্তমানে কয়েক ডজন চ্যানেল রয়েছে। ঈদ উপলক্ষ্যে সব ক’টি টিভি চ্যানেলই ৬-৮ দিন পর্যন্ত নানা অনুষ্ঠানমালা প্রচার করে। যার মধ্যে নাটক অন্যতম অনুষঙ্গ। এ ক’দিনে চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত টেলিফিল্ম, নাটকের সংখ্যা ১ হাজার না হলেও এর কাছাকাছি হবে।
এতগুলো না ধরে আমরা ধরে নেই ৫০০টি নাটক প্রচারিত হয়েছে। তাহলে এখন প্রশ্ন জাগছে, এই ৫০০ নাটকের মধ্যে আমাদের মাঝে আলোচিত হচ্ছে কয়টি নাটকের কথা? মাত্র একটি। একটি পেছনে দৃষ্টি দেই। রোজার ঈদের সময়ও সমসংখ্যক নাটক প্রচারিত হয়েছে। সেখানে আলোচিত হয়েছে তাও একটি নাটক ‘বিকাল বেলার পাখি’।
ঈদ বা বিশেষ দিবসে প্রচারিত নাটক মানে হচ্ছে, সাগর জাহান, মাসুম সেজান, শামীম জামানসহ বিভিন্ন বিশেষজনদের লেখা বা পরিচালানার নাটক। চ্যানেলগুলো মুখিয়ে থাকে তাদের নাটকের জন্য। চাহিদা আর দর্শকদের কথা বিবেচনা করে তারাও হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেন। কাউকেই নিরাশ করেন না তারা। সব চ্যানেলই তাদের নাটক পায়, দর্শকরাও হাসতে পান। তাদের নির্মিত নাটকগুলো দেখলে মনে হবে হাসানোর মিশন নিয়েই মূলত তারা এসব বানান। আর এজন্য তারা কঠোর সাধনা করেন। জোড় করে হলেও তারা হাসান। হাসান।
প্রশ্ন হচ্ছে, নাট্যকারের দায়িত্ব কি কেবলই দর্শকদের হাসানো? হাসাতে হাসাতে তারা এতটাই ক্লান্ত যে, নতুন ফ্লট তারা আর নির্মাণ করতে পারেন না। কোন রকমে একটি থিম রূপান্তর করতে পারলেই তাদের সারা হয়ে যায়। ব্যাস, আগামী কয়েক বছরের জন্য তারা নিশ্চিন্ত হয়ে যান। এরপর ত্যানা প্যাছিয়ে সেটিকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যান তারা, যে শেষ পর্যন্ত দর্শকদের ভূমির ট্যাবলেট গিলতে হয়। এই যেমন ধরুন, ‘অদ্ভুত চা খোড়’, ব্যাস; এরপর জর্দা খোড়, পান খোড়, সুপাড়ি খোড়, ইয়াবা খোড়, ঘুশ খোড় ইত্যাদি। তেমনি সেকান্দরবক্স রংপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার হাবিজাবি যেমন আছে তেমন আছে এ্যাভারেজ আসলাম প্রেম, বিবাহ, বিরহ। আবার আছে, মাহিনের জুতা, তোয়ালে, ঘড়ি; এরপর হয়তো হবে, মাহিনের হাফ প্যান্ট, আন্ডারওয়ার, চশমা হেনতেন হাবিজাবি। আরো আছে সেলফি, লাইক, কমেন্ট, সেলিব্রেটি ইত্যাদি নিয়ে সিকুয়াল থিমের নাটক। যার সবই প্রায় একই গল্পের। এসব নাটকে দর্শক হাসি ছাড়া কিছুই পান না। শেষে অবশ্য নাট্যকার জোড় করে একটি শিক্ষা বা আবেগ জুড়ে দিয়ে শেষ করেন। কিন্তু সবই মেকি।
একটি নাটক ভাল হলে সেটা সিক্যুয়েন্স দর্শকের চাহিদায় থাকাটা স্বাভাবিক। তবে সেটা পূরণ করতে গিয়ে গল্পের মৌলিকতা নষ্টোর কি কোন প্রয়োজন আছে? একটা কথা আছে, লেবু বেশি চিপলে তেতো হয়ে যায়। নাটক বা সিনেমার সিকুয়েন্সও তেমনই। বেশি বানাতে গেলে সেটা দর্শকদের বিরক্তির কারণ হয়ে যায়। আমার একটা উদাহরণ দেই্, একবার ঈদে ‘জমজ’ নামে একটা নাটক দেখে বেশ মজা পেয়েছিলাম। পরের ঈদে সেই নাটকটি দেখার জন্য বসেছিলাম। পরবর্তিতে এটি হতে হতে এখণ সম্ভবত ‘জমজ-৮’ -এ এসে ঠেকেছে। এখন এটা দেখতে বসলে বিরক্ত লাগে।
কোন নাটক জনপ্রিয় হলে দর্শক অনেক কিছুই চাবে। নাট্যকার চাইলে সেটা করতেই পারেন। কিন্তু সেটা না করাই এইজন নির্মাতার স্বাতন্ত্রতা। দর্শকের দাবী মেনে নিয়ে ‘বাকের ভাই’ -য়ের ফাঁসী না দিলে কি ‘কোথাও কেউ নেই’ এতটা জনপ্রিয় হত? দুই তিন বছর আগে বাংলাভিশনে ‘লংমার্চ’ নামে একটি দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল। পরে সেটি শেষ হয়ে আসলে দর্শকরা সেটা সমাপ্ত না করতে নাকি চিঠি দিয়েছিল। নির্মাতা মাসুম সেজান তেমনটিই জানিয়েছিলেন। কিন্তু পরে তিনি একই রকমের আরেকটি নাটক শুরু করেন। কিন্তু সেটা দর্শকদের কাছে বিরক্তের লেগেছে। এটি না করলে কি মাসুম সেজানের জন্য ভাল হত না?
নাটক আমাদের সোসাইটিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ টুল। সমাজ পরিবর্তনে এটা ভাল ভূমিকা রাখে। কিন্তু এখনকার অনেক ভাল নাট্যকার সেটিকে শুধুমাত্র হাসির খোড়াকে পরিণত করেছেন। আসকার বিন শাইখের কথা বাদই দিলাম। হুময়ুন আহমেদ, সেলিম আল দ্বীন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, আবুল হায়াতরাও তো নাটক লিখছেন বা লিখতেন। তারা হয়তো এখনাকার নাট্যকারদের মত বেশি সংখ্যক নাটক লিখতে পারেননি, কিন্তু তাদের একেকটি নাটক একেকটি অমর কীর্তি। তাই আশা করবো, সংখ্যা নয়, গুণগতমানের দিকে লক্ষ্য রাখা উচিত নাট্যকারদের। তাহলেই আমাদের দর্শকরা ভীন দেশি চ্যানেলের দিকে আর ঝুঁকবেন না।
এবার আসি, ‘বড় ছেল’ নাটকের জনপ্রিয়তা হওয়ার কথায়। এটি জনপ্রিয়তা লাওয়াটা স্বাভাবিক। কারন গতানুগতিক হাসি এবং গল্পহীন নাটকের ভীরে এমনধর্মী নাটক মানুষ না দেখে কি পারে? কিন্তু এর বাহিরেও একটা কারন তো আছেই। সেটা হল বেকারত্ব। পরিসংখ্যানে আমাদের দেশে ২৬ লাখ যুবককে বেকার হিসেবে ধরা হয়েছে। যদিও এ সংখ্যা আরো বেশি। আর এই নাটকে সেই ২৬ লক্ষ্য যুবকের বোবাকান্নটাই মূলত প্রতিধ্বনিত হয়ে এসেছে। তাই এটি কেবল ‘বড় ছেলে’ নয়, বেকারদের আর্তনাদেরই অংশ।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাংলা চলচ্চিত্রের সংকট ও সীমাবদ্ধতাঃ দুইটি বাংলা চলচ্চিত্রের পর্যবেক্ষণ ও তুলনামূলক পর্যালোচনা

কথাগুলো 'সাম্প্রদায়িক'

Coverage of Local Development Issues in Regional Newspaper of Chattogram