হিজবুত তাহরীরময় এক ইফতারে


সময়টা সম্ভবত ২০০৮ কি ০৯ সালের। এটি ছিল হিজবুত তাহরিরের রাইজিং সময়। রমজান মাস। এক বন্ধুর বাসায় ইফতারের দাওয়াত ছিল। গিয়ে দেখি আলিশান কান্ড। সরকারের একটা স্বায়িত্ব শাসিত বিভাগের কমিশনারের ছেলের দাওয়াত। স্বভাবতই সরকারের বড় বড় আমলা, রাজনৈতিক, সমাজপতি ও ব্যবসায়ীসহ এলিট সোসাইটির অনেকের ছেলেরাই ছিল সেখানে ।

প্রায় ষাট-সত্তর জন গোল করে ফ্লোরে বসা। হোস্ট বন্ধুর পাশে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক লোককে দেখলাম। বেশভূষায় শিবিরের স্টাইল। কিন্তু শিবির না, সেটা নিশ্চিত। কারন আওয়ামী রাজনীতি সংশ্লিষ্টের সাথে শিবির মেলেনা। সে যেই হোক, আমারতো আর প্রয়োজন নাই। চুপচাপ বসে থাকলাম।

ইফতারের তখনো প্রায় এক ঘন্টা বাকি। হঠাৎ করে ঘোষণা এল, “এখন আমাদের সামনে কথা বলবেন আমাদের সম্মানিত বড় ভাই কাউছার (নাম সম্ভবত এটাই বলা হয়েছিল, পুরোপুরি মনে নেই) ভাই।

‘বড় ভাই’ খুব সুন্দর উপস্থাপনার মাধ্যমে তার বক্তব্য শুরু করলেন। একেবারে সিঁড়ি আলোচনা। আমরা মুসলমান, মুসলমান বীরের জাতি, মুসলমানের পরাজয় কেন? কিভাবে আবার বিজয়ী হওয়া যায়? ইত্যাদি ইত্যাদি।

ভালই লাগছিল, তাই শুনছিলাম। খেয়াল করলাম উপস্থিত সবাই তন্ময় হয়ে শুনছে। শোনারই কথা। কারন বড়লোকদের এসব লেলিপুটেরা ধর্ম-কর্মে তেমন সাঁড়ষ না। তাই ইনিয়ে বিনিয়ে রসালো গল্প এদের ভাল লাগে। জায়গা মত ঢিল পৌঁছাতে পারলে এরা আত্মঘাতিতেও সুখ খুঁজে পায়।

‘বড় ভাই’ তার বক্তব্যের এক পর্যায়ে সোনাবাহিনীর প্রসঙ্গ তুলে আনলেন। বাংলাদেশে কত, সবগুলো মুসলিম দেশগুলোতে কত, আর সারা বিশ্বে সর্বমোট কতজন মুসলিম সেনা সদস্য রয়েছে তার একটি নজরকাড়া পাই চার্ট তুলে ধরলেন। সাথে এও বললেন, সব মুসলিম সেনা সদস্য যদি একযোগে অস্ত্র ধরে তাহলে ইহুদী-খ্রীষ্টানরা পালানোর পথ খুঁজে পাবেনা।

‘বড় ভাই’ উপসংহার টানলেন এই বলে যে, ‘মুসলমানরা বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে সব সেনাবাহিনীকে একটি কমান্ডের আওতায় আনতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন “খেলাফত” প্রতিষ্ঠা করা।’

হাহাহা এতক্ষণে পেয়ে গেছি ‘বড় ভাই’-এর পরিচয়। তিনি আর কেউ নয়, খেলাফতে ইলাহিয়ার হিজবুতি পাগলা। এদেরকে মোটামুটি চিনি। কারন কয়েকদিন আগে আমাকে এই হিজবুত তাহরীরের এক ছেলে বেশ ভোগিয়েছে।

ঐ ছেলে সকাল, দুপুর, বিকেলে আমার পিছু লেগেছিল হিজবুত তাহরীরের সদস্য করতে করার জন্য। এ নাছোড়বান্দার ঐকান্তিকতায় কিছুটা কনভিন্সও হয়ে গেছিলাম। একদিন হাটতে গিয়ে দেখি সে ছেলে সিগারেট খাচ্ছে। আমাকে দেখেতো সে আকাশ থেকে পড়ল। ব্যাচ আর আমার সামনে পড়েনি। কখনো সামনে পড়লে না দেখার ভান করে অথবা অন্যপথ ধরে। পরে তারা এলাকা থেকে চলে যায়।

যাই হোক, ‘বড় ভাই’ –এর খেলাফতের বয়ান শুনে দেখলাম, অনেক ছেলেই মজে গেছে। তারা বেশ আগ্রহী হয়ে তার সাথে সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিল। অনেকে আবেগে আপ্লুত হয়ে “খেলাফত” ব্যবস্থা কেমন হবে? সেদিন মানুষ কেমন সুখি হবে? ব্লা ব্লা ব্লা.. প্রশ্ন করতে লাগলো। ‘বড় ভাই’-ও খুশি হয়ে তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকল।

সওয়াল-জবাবের পর্ব ইফতার শেষে আরো ঘন্টাখানেক চলল। পুরোটা সময় জুড়েই স্বভাব সুলভ ভদ্র ছেলে হিসেবে চুপ করে থাকলাম
 
কিন্তু এতগুলো ছেলের বিপদগামীতা দেখে বিবেকের কাছে পরাজিত হয়ে আর চুপ থাকতে পারলাম না। শেষ দিকে হঠাৎ করে বলে উঠলাম ভাইয়া আমার একটা প্রশ্ন আছে। দুই তিন ঘন্টা চুপ থাকা ছেলের মুখে কথা ফুটতে দেখে একটু অবাক হলেও অনুমতি দিলেন।

সুযোগ পেয়ে আমি বললাম ‘আপনি যে খেলাফতের কথা বলছেন সেটা কীভাবে প্রতিষ্ঠা করবেন?’ জবাবে ‘বড় ভাই’ বললেন, ‘আল্লাহ কোরআনে যেভাবে বলেছেন আর আল্লাহর রাসুল যেভাবে ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠা করেছেন আমরা সেভাবেই করবো।’
আমি কাউন্টার প্রশ্ন করলাম, ‘ভাই, সেটা কিভাবে? আমার কোরআন-হাদীসের জ্ঞান নাই। তবে বর্তমান পৃথিবীতে ইসলামী মত ও রাজনীনৈতিক গ্রুপগুলোকে দেখে আমার মনে হচ্ছে, তারা তিনটি পদ্ধতিতে ইসলাম বা খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যেমন,- (১) একজন একজন করে পরিবর্তন হয়ে সমাজ পরিবর্তন। অর্থাৎ তবলীগে জামাত যেটা করছে। সেটা সম্ভব নয়। কারন কয়েক শ’ বছরেও তারা সফল হয়নি।
(২) বোমা মেরে। যেটা করছে জেএমবিসহ সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো। এটা অমানুবিক
(৩) গতানুগতিক গণতান্ত্রিক পন্থায়, যা করছে জামায়াত, খেলাফত মজলিসসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো।’ এটা তুলনামূলক ভাল হলেও সাধারণ মানুষ তাদেরকে গ্রহণ করেনি।

‘বড় ভাই’ মনে হয়, কিছুটা মাইনাকার চিপায় পড়েছেন। কারন তিনি ইতোপূর্বে ১ ও ৩ নম্বরের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ বক্তৃতা করেছিলেন। তিনি ছয়-নয়, করে বোঝাতে লাগলেন। কথায় কথায় বারবার চ্যাপ্টার পরিবর্ন করার চেষ্টা চালান। কিন্তু উনি যতবারই পাশ কাটাতে চান, ততবারই আমি প্রসঙ্গটা টেনি আনি। কিন্তু লাভ হচ্ছে না, প্রসঙ্গ আনলেই উনি মুসলমানদের ঐক্যের দিকে দৌড় দেন। এভাবে রাত ১০টা বেজে যায়। তর্কে তর্কে সময় কাটতে লাগলো আর তাকে সমর্থনকারি ছেলেদের দল কমতে থাকলো।
শেষমেষ তাকে সমর্থন করার মত একজনও রইলো না। বেচারার মূখ দেখেই বুজেছি আমার উপর নিদারুণ ক্ষুব্ধ (এখনকার দিন হলে হয়তো, চাপাতি বসিয়ে দিত ঘাড়ে। আল্লাহ বাছিয়েছেন)। কিন্তু তিনি এখন নিরাপদ এক্সিট চাচ্ছেন। তাই আমাকে নামাজের তাড়া দিয়ে বললেন, আমি যেন তাকে তর্কের জন্য একদিন সময় দেই। সেদিন তিনি আমার সব প্রশ্নের উত্তর দেবেন।

সেই দিন আর এলোনা। এখনো মাঝে মাঝে যখন পত্রিকায় জঙ্গি গ্রেফতারের খবর দেখি, তখন সেখানে তাকে খোঁজার চেষ্টা করি। পাইনা। অবশ্য এখন তার চেহারাও ভুলে গেছি। আমার বন্ধুর সাথেও সেদিনের পর থেকে তার দেখা হয়নি। তবে দিন শেষে আমার একটা তৃপ্তি আছে। আমার একটা প্রশ্নের কারনে অন্তত একটা ছেলেকে হলেও বাঁচাতে পেরেছি বিপদগামীতার হাত থেকে। এটাতেই, এতেই শান্তি...
 
ফেসবুকে পড়ুন 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাংলা চলচ্চিত্রের সংকট ও সীমাবদ্ধতাঃ দুইটি বাংলা চলচ্চিত্রের পর্যবেক্ষণ ও তুলনামূলক পর্যালোচনা

কথাগুলো 'সাম্প্রদায়িক'

Coverage of Local Development Issues in Regional Newspaper of Chattogram