এপ্রিল ফুলের ইতিকথা


কয়েক বছর আগে দেশের প্রায় সবগুলো মিডিয়া বিশেষ করে টেলিভিশন গুলোতে একটি বিজ্ঞাপন সাধারণ মানুষকে আতংকিত এবং চিন্তিত করে তুলেছিল। বিজ্ঞাপনটি ছিল এমন, টেলিভিশনের অনুষ্ঠান চলছে মুহুর্তে হঠাৎ করে বিশেষ সংবাদ নামক একটি খবর পরিবেশন করা হয়, যাতে বলা হয় মডেল ও অভিনেত্রী জয়া আহসান নিখোঁজ ! মোবাইল ফোন বন্ধ, কোন যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। ভাবুনতো কি অবস্থা ! অনেককেই হায় হুতাশ করতে করতে দেখা গিয়েছিল। পরের ঘটনাতো সবাই জানেন। এটি একটি মোবাইল কোম্পানির বিজ্ঞাপন। কেউ যেন কখনো মোবাইল ফোন বন্ধ না রাখেন সে বিষয়ে গণ-সচেতনতা (!!) সৃষ্টির লক্ষ্যে। আমাদের আলোচনার বিষয় কিন্ত বিজ্ঞাপনটি নিয়ে নয়। বিজ্ঞাপনের বিষয় উপস্থাপনের প্রকৃয়াটি তুলে কিছু সত্য অবলোকন করাই মূখ্য।

বর্তমান সমাজে একটি সংস্কৃতির প্রচলন রয়েছে, শুধুমাত্র আমাদের সমাজ নয় বরং পুরো দুনিয়াজুরেই এটি প্রচলিত। প্রতিবছর এপ্রিল মাসের ১ তারিখে একজন আরেকজনকে বোকা বানানোর ক্রিয়ায় রত হন। এর বিস্তৃতি এতটাই প্রগাঢ় যে শুধুমাত্র বন্ধু মহলে আবদ্ধ না থেকে পিত-পুত্র, ভাই-বোন, ছাত্র-শিক্ষক, করনিক-কর্তা নানান শ্রেণী বর্ণে এটি আজ প্রচলিত। এর নাম দেয়া হয়েছে এপ্রিলফুল। এদিন একজন আরেকজনকে কতবেশী বোকা বানাতে পারে সে প্রতিযোগীতায় লীপ্ত হতে দেখা যায় কম বেশী সবাইকে।

কেন এই এপ্রিল ফুল? এ প্রথার সূচনা কিভাবে হলো, এ ব্যাপারে ঐতিহাসিক বর্ণনা নানারকম। আবার রয়েছে এসব বর্ণনার বিপরীতে অবস্থান। রয়েছে এটিকে নিয়ে মিথ্যাচার। আবার রয়েছে সত্যকে অস্বীকার করা বা ঢেকে রাখার মত হীন প্রচেষ্টা।

এপ্রিল ফুল নিয়ে বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্তকার বিভিন্ন বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। কতক গ্রন্তকারের বক্তব্য এই যে, সপ্তদশ খ্রীঃ এর পূর্বে ফ্রান্সে বছর গণনা জানুয়ারীর পরিবর্তে এপ্রিল থেকে আরম্ভ হত। রোমনরা এই মাসকে তাদের দেবী Venus এর সাথে স¤পৃক্ত মনে করে একে সম্মানিত মাস মনে করত। গ্রীক ভাষায় ভেনাস (venus) শব্দের অর্থ করা হত Aphrodite আর সম্ভবত গ্রীক ভাষায় এই শব্দ থেকেই এপ্রিল শব্দটি উদ্ভাবন করে তা দ্বারা এই মাসের নামকরণ করা হয়েছে। ( ব্রিটেনিকা/ ১৫তম সংস্করণ/পৃঃ ২৯২/ খন্ডঃ ৮) যেহেতু ১ লা এপ্রিল বছরের প্রথম তারিখ ছিল এবং তার সাথে মূর্তিপূজার ভক্তি-বিশ্বাসও জড়িত ছিল,তাই এই দিনকে মানুষ আনন্দ দিবসরূপে উদযাপন করত। হাসি-ঠাট্টা করাও ছিল সে আনন্দের একটি অংশ। যা ক্রমশ উন্নতি করতে করতে এপ্রিল ফুলের রূপ ধারণ করেছে। কেউ কেউ বলেন, আনন্দ উদযাপনের এই দিনে মানুষ পরস্পরকে উপঢৌকন দিত। একবার জৈনিক ব্যাক্তি উপঢৌকনের নামে ঠাট্টা করে। অবশেষে তা অন্যান্যদের মধ্যেও প্রচলিত হয়ে যায়।

ব্রিটেনিকায় এ প্রথার আরেকটি কারণ বর্ণনা করা হয়েছে যে, মার্চের একুশ তারিখ হতে ঋতুর মধ্যে পরিবর্তন আসতে আরম্ভ করে। এই পরিবর্তনকে কতিপয় লোক এভাবে ব্যক্ত করে যে, প্রকৃতি আমাদের সাথে ঠাট্টা করে বেওকুব বানাচ্ছে। বিধায় মানুষও সে যুগে পরস্পরকে বেওকুব বানাতে আরম্ভ করে। (ব্রিটেনিকা/পৃঃ ৪৯৬/ খন্ডঃ ১) তবে একথা এখনো অ¯পষ্টই রয়ে গেছে যে, প্রকৃতির এই ঠাট্টার পরিণতিতে এ প্রথার প্রচলন ঘটানোর দ্বারা প্রকৃতির অনুসরণ উদ্দেশ্য ছিল, নাকি তার থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করা উদ্দেশ্য ছিল?!

ঊনবিংশ খৃষ্ট শতাব্দীর নামকরা এনসাইক্লোপিডিয়া লারুস এ তৃতীয় একটি কারণ বর্ণনা করেছে এবং সে এটিকেই এর যথার্থ কারণ বলে সাব্যস্ত করেছে। সে কারণটি এই যে, প্রকৃতপক্ষে ইহুদী ও খ্রীস্টানদের বর্ণনা অনুপাতে ১লা এপ্রিল সেই তারিখ, যেই তারিখে ইহুদী ও রোমানরা হযরত ঈসা(আঃ) কে ঠাট্টা ও বিদ্রুপের পাত্র বানায়। বর্তমানের নামসর্বস্ব ইঞ্জীলসমূহে এসব ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। এ সম্পর্কে লুকা- এর ইঞ্জিলের ভাষ্য এই- এবং যে ব্যক্তি তাঁকে (অর্থাৎ হযরত ঈসা আঃ) বন্দী করে রেখেছিল, সে তাঁর সঙ্গে উপহাস করত, তাঁকে প্রহার করত এবং তাঁকে এভাবে জিজ্ঞাসা করত যে, নবুওয়াত (অর্থাৎ ইলহাম) দ্বারা বল তোকে কে মেরেছে? এমনিভাবে বিদ্রুপ করে সে তাঁর বিরুদ্ধে অনেক কথা বলত। (লুকাঃ ২২/৬৩-৬৫)

এপ্রিল ফুলের আরেকটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রফেসর জোসেফ বসকিন। তিনি বলেছেন, এই প্রথাটির শুরু হয় রোমান সম্রাট কনস্ট্যান্টাইনের শাসনামলে। হাসিঠাট্টা নিয়ে মেতে থাকে এমন একদল গোপাল ভাঁড় জাতীয় লোক একবার সম্রাটকে কৌতুক করে বলল,জাহাপনা, আমরা আপনার চেয়ে ভালোভাবে দেশ চালাতে পারবে। এ কথা রাজা মহোদয় বেশ পুলকিত হলেন। রাজা গোপাল ভাঁড়দের সরদার কুগেলকে এক দিনের জন্য বাদশাহ বানিয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দিলেন। আর কুগেল সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে রাজ্যময় আইন জারি করে দিলো যে, প্রতি বছরের এই দিন অর্থাৎ ১লা এপ্রিল সবাই মিলে হাসি-তামাশা করবে। ব্যাস, তখন থেকেই চালু হয়ে যায় এপ্রিল ফুল ডে।

ইতিহাসের পাতায় এপ্রিল ফুল ডের উৎপত্তি সম্পর্কে নানা হাস্যরস, কৌতুক আর আমোদ-প্রমোদের কথা থাকলেও পাশাপাশি রয়েছে শোক ও বেদনার এক কালো পাহাড়। বেদনায় ভরা ঐ ইতিহাস জানতে হলে আমাদের একটু পেছনে তাকাতে হবে। অষ্টম শতাব্দীর প্রথম দিকে বিখ্যাত মুসলিম সেনাপতি তারিক বিন রিয়াদের নেতৃত্বে মুসলমানরা স্পেন বিজয় করেন। মুসলিম শাসকদের সুশাসনে স্পেন হয়ে উঠে ইউরোপসহ সারা বিশ্বের মানুষের জন্য জ্ঞান বিজ্ঞানের একটি কেন্দ্র। শক্তির দিক থেকেও স্পেন ছিল অপ্রতিরোধ্য। একটানা ৭০০ বছর শাসন করার পর মুসলমানরা স্পেনের পার্শ্ববর্তী খ্রিস্টান শাসকদের চক্রান্তের শিকার হয়। স্পেনের মাটি থেকে মুসলমানদের উচ্ছেদ করার ঘোষণা দিয়ে পর্তুগীজ রাণী ইসাবেলা চরম মুসলিম বিদ্বেষী পার্শ্ববর্তী খ্রিষ্টান সম্রাট ফার্ডিনান্ডকে বিয়ে করে। বিয়ের পর দুজন মিলে সম্মিলিত বাহিনী গড়ে তোলে স্পেন আক্রমণের। ১৪৯২ সালে স্পেনে মুসলমানদের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে। এর আগেই রাজা ফার্ডিনান্ড মুসলমানদের হাত থেকে কর্ডোভাসহ অন্যান্য অঞ্চল দখল করে নেয়। বাকি ছিল শুধু গ্রানাডা। গ্রানাডার শাসনকর্তা ছিলেন হাসান। খ্রিস্টানরা তার উপর চাপ সৃষ্টি করছিল, আত্মসমর্পনের জন্য। কিন্ত তিনি কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। তাকে আত্মসমর্পনে রাজি করাতে না পেরে খ্রিস্টানরা তার পুত্র আবু আবদুল্লাহকে সিংহাসনে বসানোর লোভ দেখিয়ে হাত করে ফেলে। আবদল্লাহ তাদের কথায় রাজি হয়ে পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং এক সময় বাদশাহ হাসান পুত্রের সাথে যুদ্ধ করার গ্লানি এড়ানোর জন্য তার এক ভাইয়ের হাতে সিংহাসন ছেড়ে দিয়ে দেশান্তরীত হন।

আবু আব্দুল্লাহ বিশ্বাসঘাতকতা করলেও তার সেনাপতি মহাবীর মুসাসহ অনেক মুসলমান ফার্ডিনান্ড বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। এর আগে কখনো সম্মুখ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজিত করতে পারেনি বলে চতুর ফার্ডিনান্ড এবার পা বাড়ায় ভিন্ন পথে। তার নির্দেশে আশপাশের সব শস্যখামার জ্বালিয়ে দেয়া হয় ৷ অচিরেই দুর্ভিক্ষ নেমে আসে গ্রানাডা শহরে । দুর্ভিক্ষ যখন প্রকট আকার ধারণ করে তখন প্রতারক ফার্ডিনান্ড ঘোষণা করে, মুসলমানরা যদি শহরের প্রধান ফটক খুলে দেয় এবং নিরস্ত্র অবস্থায় মসজিদে আশ্রয় নেয় তাহলে তাদের বিনা রক্তপাতে মুক্তি দেয়া হবে। সেদিন ছিল ১৪৯২ সালের ১ এপ্রিল। গ্রানাডাবাসী অসহায় নারী ও মাসুম বাচ্চাদের করুণ মুখের দিয়ে তাকিয়ে খ্রিষ্টানদের আশ্বাসে বিশ্বাস করে খুলে দেয় শহরের প্রধান ফটক। সবাইকে নিয়ে আশ্রয় নেয় আল্লাহর ঘর পবিত্র মসজি। শহরে প্রবেশ করে খ্রিষ্টান বাহিনী মুসলমানদেরকে মসজিদের ভেতর আটকে রেখে প্রতিটি মসজিদে তালা লাগিয়ে দেয়। এরপর একযোগে শহরের সমস্ত মসজিদে আগুন লাগিয়ে বর্বর উল্লাসে মেতে ওঠে হায়েনারা।

সেদিন লক্ষ লক্ষ নারী,পুরুষ ও শিশু অসহায় আর্তনাদ করতে করতে জীবন্ত পুড়ে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারায় মসজিদের ভেতর। অসহায় মুসলমানদের আর্তচিৎকার যখন গ্রানাডার আকাশ-বাতাস ভারী করে তোলে- তখন রাণী ইসাবেলা হেসে বলতে লাগলো, হায় এপ্রিলের বোকা ! শত্রুর আশ্বাস কেউ কি বিশ্বাস করে? সেই থেকে খ্রিষ্টান জগত প্রতি বছর ১লা এপ্রিল আড়ম্বরের সাথে পালন করে আসছে- April Fool মানে এপ্রিলের বোকা উৎসব।

গ্রানাডা ট্রাজেডিই কিন্ত শেষ এপ্রিল ফুল নয়। খ্রিস্টান ও ইহুদিরা এখনও নানাভাবে মুসলমানদের এপ্রিল ফুল বানিয়ে চলেছে। ১৯৯৩ সালের ১ এপ্রিল গ্রানাডা র্ট্যাজেডির ৫০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে স্পেনে এক সভায় মিলিত হয়েছিল বিশ্ব খ্রিষ্ট সম্প্রদায়। সেখানে তারা নতুন করে শপথ গ্রহণ করে একচ্ছত্র খ্রিষ্টীয় বিশ্ব প্রতিষ্ঠার। বিশ্বব্যাপী মুসলিম জাগরণ প্রতিহত করার জন্য গড়ে তোলে হলি মেরি ফান্ড। আর এরই ধারাবাহিকতায়  গোটা খ্রিষ্টান বিশ্ব নানা অজুহাতে একের পর এক মুসলিম দেশগুলোতে আগ্রাসন চালাচ্ছে।

এপ্রিল ফুল ডের এ মর্মান্তিক ইতিহাস জানার পরও কি আমরা এ দিনটিকে আমোদ-প্রমোদ কিংবা আনন্দের দিন হিসেবে পালন করতে পারি? কক্ষনোই না। এ দিনটি আসলে হওয়া উচিত আমাদের শোকের দিন, ইসলামের শত্রুদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দিন।

তাছাড়া, যে প্রথার ভিত্তি মিথ্যা,প্রতারণা এবং নিষ্পাপ লোককে বিনা কারণে বোকা বানানোর উপর, তা নৈতিক দিক থেকে যে মারাত্মক ধৃষ্টতা ও অমার্জনীয় অপরাধ তাতো বলার অপেক্ষা রাখে না। উপরন্ত যারা হযরত ঈসা(আঃ) এর মর্যাদা ও পবিত্রতার উপর সামান্যতমও ঈমান রাখে, তাদের জন্য এর ঐতিহাসিক দিকটিও নিতান্ত লজ্জাজনক।

মানুষকে ধোঁকা দেয়া, প্রতারণা করা এসব কিন্ত ইসলামী আদর্শের পরিপন্থী। ১লা এপ্রিলে যেভাবে মিথ্যা বলে রসিকতা করার চেষ্টা করা হয় তা কোনভাবেই মুসলমানদের সংস্কৃতি হতে পারে না। রাসূলে (স.) বলেছেন, আমি রসিকতা করি ঠিক কিন্ত কখনো মিথ্যা বলি না। তিনি আরও বলেছেন, ধ্বংস তার জন্য- যে লোক হাসানোর জন্য কথা বলে এবং তাতে সে মিথ্যার আশ্রয় নেয়। সুতরাং এপ্রিল ফুলের নামে আমরা কেউই কাউকে প্রতারণা করবো না এবং মিথ্যার আশ্রয় নেবো না-এই হোক আজকের দিনের অঙ্গীকার।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাংলা চলচ্চিত্রের সংকট ও সীমাবদ্ধতাঃ দুইটি বাংলা চলচ্চিত্রের পর্যবেক্ষণ ও তুলনামূলক পর্যালোচনা

কথাগুলো 'সাম্প্রদায়িক'

Coverage of Local Development Issues in Regional Newspaper of Chattogram